তুরস্কের শাইখ মাহমুদ এফেন্দির সান্নিধ্যে সামান্য সময়

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ১১ ২০২২, ১৩:১৭

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী: ইস্তাম্বুল সফরের বেশ আগে থেকেই শাইখ এফেন্দির নাম ও অবদান সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ হয়। তাঁর জীবনধারা সম্পর্কে কোনো এক লেখায় পড়া এই কথাগুলো আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তিনি নিজের অনুসারীদের বলতেন, মুত্তাকী সেই ব্যক্তি যাকে এক ওয়াক্ত নামায ত্যাগ করার বিনিময়ে পুরা দুনিয়াটা দিয়ে দিলেও সে বলবে, আমার এক ওয়াক্ত নামায তোমাদের এই দুনিয়ার চেয়ে উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চার হাজার ব্যবহারিক সুন্নত রয়েছে। আমি যদি সেগুলো থেকে তিন-চারটি সুন্নতও পরিত্যাগ করি, তাহলে তোমরা আমার পেছনে নামায পড়ো না। আবু জাহল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছিল। আর আজকের মুসলমানরা নিজের অন্তর থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিদায় করে দিয়েও ঈমানের দাবি করে। আসলে এরা আবু জাহলের চেয়ে কম নয়। শিক্ষক ছাড়া ইলম হাসিল করা যায় না। মুর্শিদ ছাড়া তাকওয়া হাসিল করা যায় না। তিনি শাইখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী রহ. এর বাণী উদ্ধৃত করে বলতেন, ইস্তিকামত থাকাই হলো কারামতের মূল। ফরয ও সুন্নত না ছাড়া, গোনাহের কাজ না করা। আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সুন্নত অনুসরণই হচ্ছে নকশবন্দী তরিকা।

শাইখ এফেন্দি সম্পর্কে উপমহাদেশীয় উলামায়ে কেরামের লেখা ও বয়ানের সাথে পরিচিত ছিলাম। বিশেষ করে ইস্তাম্বুলে এক আন্তর্জাতিক উলামা সম্মেলনে এই শাইখকে হযরত কাসেম নানুতুভী অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। এতে উপমহাদেশের অনেক আলেম অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে প্রদত্ত হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী সাহেবের আরবী বক্তৃতাটি আমি শুনেছি। এরপর সোশাল মিডিয়ায় শাইখ মাহমুদ এফেন্দির সাক্ষাতে আল্লামা মুফতী তকী উসমানী সাহেবকে দেখতে পাই। এতে শাইখের প্রতি মহব্বত আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন বই-পত্র ও প্রবন্ধ পড়ে শাইখের সংগ্রাম ও সাধনাপূর্ণ জীবনের নানা দিক জানতে পারি। আমার শাইখ হাফেয মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী সাহেবকে শাইখ এফেন্দির সোহবতে হাজির হতে দেখি। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সফল ও শক্তিধর নেতা তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তায়্যিব এরদোগানকে শাইখের কাছে মাঝে মধ্যে ফয়েজ ও দুআ লাভের জন্য হাজির হতে মিডিয়ার মাধ্যমে দেখতে পাই।

২০১৯ সালে ইস্তাম্বুল সফরের সময় সৌভাগ্যক্রমে আমরা কয়েকজন শাইখ এফেন্দির সাক্ষাৎলাভে ধন্য হই। তিনি তখন খুবই অসুস্থ। তাঁর অফিস থেকে বলা হয়, ১৫ দিন যাবত আমেরিকার একদল আলেম ও দ্বীনদার ব্যক্তি শাইখের সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করে গতকাল চলে গেছেন। এই মুহূর্তে সাক্ষাতের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও মনের টান ও প্রবল আকাংক্ষা নিয়ে ইস্তাম্বুল থেকে বিদায়ের দিন এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে দুই তিন ঘণ্টা বাড়তি সময় হাতে রেখে আমরা শাইখের খানকাহ ও বাসস্থানে চলে যাই। আমাদেরকে তাঁর অফিসের জিম্মাদাররা খুব মহব্বতের সাথে স্বাগত জানান এবং বাসার মেহমানখানায় বসতে দেন।

এ সময় শাইখের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছিল। ছোট্ট স্ক্রিনে আমরা অনেকেই তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন সংগ্রাম দেখে ভাবছিলাম, তাঁর সাথে দেখা বোধ হয় হবে না। তখন আমি তাঁর প্রধান খলীফা এবং বর্তমান জানিশীন শাইখ হাসান এফেন্দি সাহেবের কাছে গিয়ে বললাম, যদি সুযোগ থাকে তাহলে শাইখের কানে এই কথাটি দিলে ভালো হয় যে বাংলাদেশ থেকে কিছু আলেম তাঁকে দেখতে এসেছেন। যাদের পক্ষে ঘন ঘন আসা সম্ভব নয়। আজই তাদের ফিরতি ফ্লাইট। তিন ঘণ্টার জন্য তারা শাইখের সোহবতে থাকতে এসেছেন। শুধু তাঁর বরকতময় জায়গাটিতে আসতে পেরেই তারা ধন্য। যদি শাইখ পারেন তাহলে তাদের কয়েকজনকে রোগশয্যাপাশে দাঁড়িয়ে শাইখকে সালাম করে যাওয়ার সুযোগ দিলে এই মানুষগুলোর জীবন ধন্য হয়।

শাইখ মাহমুদ এফেন্দি রহ.

এর দশ মিনিট পর খানকার একজন জিম্মাদার বললেন, শাইখ আপনাদের আবেদন শুনেছেন। বলেছেন, ‘তাদের কিছু লোক ওপরে এসে আমাকে দেখে যাবে, এরচেয়ে বরং তোমরা আমাকে তৈরি করে সামান্য সময়ের জন্য নিচে নিয়ে যাও।’ আপনারা অপেক্ষায় থাকুন। শাইখকে নিচে আনা হবে।

আমরা কয়েক জন বিশেষ করে আমার দুই সহোদর কবি মুহিব খান ও ডক্টর মাওলানা খলীলুর রহমান খানসহ একটি বাংলাদেশী আলেম প্রতিনিধি দল সে দিন শাইখ মাহমুদ এফেন্দীর দেখা পাই। হুইল চেয়ারে বসা একজন নীরব, ধ্যানী, চক্ষুমুদিত, শান্ত সমাহিত বান্দা আমাদের সামনে আসেন। তিনি কয়েক বছর যাবত এমনই ধ্যানমগ্ন ও দীর্ঘ নীরবতায় থাকেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই আমার কাছে তাঁর এলাকা, মসজিদ, খানকা, মেহমানখানা, লন, বাগান, বাড়ি এমনকি দূরের পার্বত্য টিলা এবং দৃশ্যপটের আকাশ, বাতাস, প্রকৃতি সবাইকে তাঁর মতোই মোরাকাবারত মনে হয়েছে। বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলছি না, সেখানে যাওয়ার পর থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তাঁর পুত্র ও বাড়ির শিশুরাসহ অন্তত ত্রিশ জন খাস খলীফা, ভক্ত ও খাদেম মেহমানখানায় এসেছেন। প্রতিটি মানুষকে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও মালিকের যিকিরে নিমজ্জিত মনে হয়েছে।

আমরা সেখানে যোহরের জামাত পড়েছি। নামাযে এত স্বাদ ও নিমগ্নতা সহজে দেখা যায় না। নকশবন্দী ধারার এই সাধনাকেন্দ্র নীরব কোরআনী শিক্ষাবিপ্লবের মাধ্যমে তুরস্কের জীবনব্যবস্থা বদলে দিয়েছে। শাইখ এফেন্দির লক্ষ লক্ষ মুরীদ নিজেদের আত্মিক সুস্থতার দ্বারা তুরস্কের ধর্মবিদ্বেষী হিংস্রতা ও পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসারী পশুত্বকে উত্তমরূপে মোকাবিলা করেছেন। প্রতিটি জনপদে বিপন্ন ইসলাম ও মুসলমানের পুনরুজ্জীবন এ ধরনের ঈমানী, ইলমী, আখলাকী বিপ্লবের দ্বারাই সম্ভব। বলা হয়, তাঁর মুরীদের সংখ্যা ৬০ লাখেরও বেশি।

শাইখকে যখন খাদেমরা হুইল চেয়ারসহ নীচ তলার মেহমানখানায় এনে নামালেন তখন আমরা সবাই তিন দিকে লাগানো সোফায় বসা। হুইল চেয়ার মাঝখানে এনে রাখা হয়েছে। আমাদের দুয়েকজন তাঁর খলীফাদের অনুমতিক্রমে শাইখের হাতে স্পর্শ করার সুযোগ পাই। মনের তীব্র আকাংক্ষা ছিল যেন তার ধ্যান ভঙ্গ হয়। তিনি যেন আমাদের দিকে ফিরে তাকান। প্রবল আকাক্সক্ষা কাজ করে। একবার শাইখ চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকান এবং অব্যক্ত ভাব ও অনুভূতি, মমতা ও ভালোবাসা ঠোঁটভাঙা কান্নার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তাঁর খোলা চোখ ও নিঃশব্দ শিশুসুলভ কান্না আমাদের সব তৃষ্ণা নিবৃত করে দেয়। ততক্ষণে আমাদের এয়ারপোর্টে যাওয়ার শেষ সময় এসে গেছে। আমরা বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসি। এরপর শাইখের অফিস থেকে প্রতি ঈদে ঈদ শুভেচ্ছার কার্ড, কাজের পদ্ধতি ও মাহমুদ এফেন্দি জামাতের রীতি অনুযায়ী দাওয়াতের নিয়ম ইত্যাদি নিয়মিত আসতে থাকে। শাইখের বিস্তারিত জীবনবৃত্তান্ত, অসংখ্য কারামাত ও তাঁর রচিত তাফসীর এবং কিতাবাদির বিবরণ ভবিষ্যতে বাংলাভাষী পাঠকের সামনে আসার প্রয়োজন রয়েছে।

চলতি বছরের ২৩ জুন বৃহস্পতিবার দুনিয়াকে বিদায় জানিয়ে রূহের অন্তর্বর্তিলোকে চলে গেলেন তুরস্কের এই শাইখ। শাইখ মাহমুদ এফেন্দি। পরের দিন শুক্রবার বাদ জুমা ইস্তাম্বুলের ফাতেহ মসজিদে কমপক্ষে ৩০ লাখ ভক্তের উপস্থিতিতে তাঁর নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত থেকে তাঁর জানাযা বহন করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এরদোগান ছিলেন শাইখের রূপরেখায় তৈরি দ্বীনি শিক্ষার একজন ছাত্র। তাঁর পুরা নাম শাইখ মাহমুদ উস্তা উসমান উগলু। মাহমুদ হাযরাতলেরি নামে তুরস্কের মানুষ তাকে বেশি চিনত। আর সারা বিশ্বে মাহমুদ এফেন্দি নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। ৯৩ বছর বয়সে তাঁর ওফাত হয়। তিনি বিংশ শতাব্দীতে তুরস্কের বৃহৎ আধ্যাত্মিক জামাত ‘জামাতে ইসমাঈল আগা’র প্রধান ছিলেন। সংগঠনটি ইস্তাম্বুলের ফাতেহ এলাকার যে জামে মসজিদ থেকে কাজ শুরু করে এর নাম ইসমাঈল আগা। এর প্রতিষ্ঠাতা ও আমীর ছিলেন শাইখ এফেন্দি।

শাইখ মাহমুদ এফেন্দির নামাজে জানাজার দৃশ্য

মাহমুদ এফেন্দি ১৯২৯ সালে কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী তারাবযুন এলাকার ওফি শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা-মাতা ছিলেন খুবই আল্লাহওয়ালা। প্রথমে তাকে খুব ছোটবেলায় হেফয করানো হয়। এরপর শিক্ষা দেওয়া হয় আরবী ও ইসলামী জ্ঞান। বড় হয়ে তিনি ইলমে কালাম, তাফসীর, হাদীস, ফিক্হ ও এসবের উসূল শিক্ষা লাভ করেন। পাশাপাশি তিনি ইলমী ভাষা আরবী ও প্রচলিত শিক্ষার ভাষা ফার্সিও অর্জন করেন। তাঁর মাতৃভাষা ছিল তুর্কি। ষোলো বছর বয়সে কিতাবী ও জ্ঞানগত শিক্ষার সনদ লাভ করে নিজ গ্রাম ও আশেপাশে দ্বীনি শিক্ষা দানে লেগে পড়েন। এরপর তিন বছর তিনি তুরস্কের নানা অঞ্চলে দ্বীনি শিক্ষা প্রসারে কাজ করেন। এসময়ে তিনি গণমানুষের জীবনে নানা সমস্যা শরীয়তের আলোকে সমাধানের পথ নির্দেশ করতেন।

১৯৫৩ সালে নিজ স্ত্রীসহ—যিনি তাঁর মামাতো বোন ছিলেন—ইস্তাম্বুলে চলে যান। তাঁদের ছিল দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তান। ফাতেহ এলাকায় তার অবস্থানের ইচ্ছা ছিল। সেখানকার জামে ইসমাঈল আগা নামের যে মসজিদটি ধর্মহীন সেকুলার সরকার এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। ব্যবসায়ী মসজিদটি কিনে তার মালের গুদাম, সবজির আড়ৎ ও গবাদি পশুর ঘর হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছিল। এ ঘটনাটি শাইখ এফেন্দির মনে খুবই আঘাত দেয়।

শাইখ তখন সেখানকার তাঁর এক বন্ধু আলী হায়দারকে এই মসজিদটি কিনে বা ভাড়া নিয়ে দ্বীনের মারকায বানানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধিতা হবে ভেবে বন্ধু আলী হায়দার এতে রাজি হননি। পাশাপাশি তিনি এমন বৈরি পরিবেশে একটি দ্বীনি মারকায খোলার কারণে তাঁর এবং তাঁর বন্ধু মাহমুদ এফেন্দির ওপর নেমে আসা সম্ভাব্য রাজরোষ থেকেও দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শাইখ এফেন্দি নিজে সাহস করে গুদাম আকারে বেচে দেওয়া এ মসজিদটিকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে এর আগের রূপে ফিরিয়ে নিলেন। তিনি সেখানে অবস্থান করে ইসলামী শিক্ষাদান শুরু করেন। ধীরে ধীরে ভীতসন্ত্রস্থ মানুষ তাঁর দরসে শামিল হতে থাকে।

কিছু দিন পর দশ পনেরো জন লোককে এখানে নামাযের জামাতে শরীক হতে দেখা যায়। এসময় শাইখ মাহমুদ এফেন্দি ক্রেতার নীরব সমর্থনে এই মসজিদটি তাঁর গৃহ হিসেবে প্রচার দেন এবং নানা বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য তালীম ঘর হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি মহল্লার ঘরে ঘরে, বাজারে ও দোকানে আসা-যাওয়া করতে থাকেন। নিজেকে মাহমুদ নামক মুসলমান ভাই পরিচয় দিয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের প্রতি মহব্বত নিয়ে আসা-যাওয়া করেন বলে প্রকাশ করেন। এতে মানুষের মন তাঁর দিকে ঝুকতে থাকে।

রাষ্ট্রের ধর্মবিদ্বেষ ও ধার্মিকদের প্রতি কঠোরতার সময় এই নিষ্পাপ নূরানী চেহারার মাহমুদ এফেন্দিকে মানুষের খুব পছন্দ হয়। অনেকের তাঁর সাথে সম্পর্ক হয়ে যায়। তারা তাঁকে দেখার জন্য মসজিদে আসতে শুরু করে। তাঁর দরসে বসতে শুরু করে। নিজেদের সন্তানকে হিফয ও দ্বীনি শিক্ষার জন্য শাইখের হাতে তুলে দেয়। ধীরে ধীরে তাঁর ছাত্র ও মুরীদ তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠে। কেউ হাফেয হয়, কেউ আলেম হয়। শাইখ তাদের তুরস্কের গ্রাম ও শহরগুলোতে ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠাতে শুরু করেন। তারা মানুষকে ঈমান শিক্ষা দেয়, হালাল-হারামের জ্ঞান দেয় এবং সরকার ও সেনাবাহিনী যেসব বিষয় বৈধ করে তাদেরকে এসব সম্পাদনে বাধ্য করত সেগুলোর নিষিদ্ধতা ও হারাম হওয়া সম্পর্কে জনগণকে মহব্বতের সাথে ন¤্রভাষায় বোঝাতে থাকে। যেমন, মদ্যপান, জুয়া খেলা, ক্লাবে গিয়ে নাচ-গান অশ্লীলতা, শুয়োরের গোশত ভক্ষণ এবং নারীদের পোশাকহীনতা। এ সময়টি ছিল শাইখ এফেন্দির জীবনের সর্বাপেক্ষা কর্মতৎপর সময়। তিনি তাঁর কাজের উসূল তৈরি করেন হানাফী মাযহাবের ভিত্তিতে। এই ঐক্য এবং ভিত্তি মনে নিয়ে তাঁর জামাত চলতে শুরু করে। আর তাঁর মুরীদ সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। তারা বয়স্কশিক্ষা লাভ করে এবং ছাত্ররা নিয়মিত শিক্ষা লাভ করে ইস্তাম্বুল তো বটেই, এর বাইরেও তুরস্কের ৮১টি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি ছিলেন অসম সাহসী লোক। হতাশা তাঁকে কোনোদিন স্পর্শ করেনি। নিরাশ হওয়াকে তিনি কুফরি মনে করতেন।

ছাত্ররা অভিযোগ করত, কোনো জায়গায় যাওয়া, থাকার আশ্রয় পাওয়া, হিফয ও মকতবে ছাত্র পাওয়া, ওয়াজ ও দরসের শ্রোতা পাওয়া খুবই কঠিন। অনেকে রাষ্ট্র ও সরকারের বাধাকে এড়িয়ে পরিচয় গোপন করে ইসলামের শিক্ষা প্রচার করা অসম্ভব বলেও শাইখকে জানাত। শাইখ বলতেন, কোনো গ্রামে কি আকাশের নিচে থাকার জায়গা নেই? একটি গাছ কি এমন খুঁজে পাও না, যার নিচে তোমার মাদরাসা হতে পারে। সেখানে বসেই আল্লাহর দীনের কথা বলতে থাকো। শ্রোতা কম হোক। ছাত্র না থাকুক। আল্লাহ নিজে জিম্মাদার হয়ে তোমার কথা সব জায়গায় ছড়িয়ে দেবেন।

সময়ের ব্যবধানে দেখা গেল মানুষ তাদের কাছে আসছে। বরং কিছু দিন পর তারা কোরআন হিফযসহ দীনি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। আর অবস্থার পরিবর্তনে তুর্কিরা এখন মাহমুদ এফেন্দির এই ভূমিকার জন্য গর্ববোধ করে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান কোনো উপলক্ষ্যে কোরআন তেলাওয়াত করলে গোটা মুসলিম জাতি আনন্দিত হয়। এটি শাইখ এফেন্দির শিষ্য শাইখ কামাল এফেন্দির কৃতিত্ব, যিনি সরকারকে কেবল স্টাফ ইমাম খতীব তৈরির জন্য একটি স্কুল চালু রাখার পক্ষে এনেছিলেন। এরদোগান সে স্কুলেরই গ্র্যাজুয়েট। শাইখ এফেন্দিকে সারা জীবন ধর্মহীন সেকুলার ও পশ্চিমা গণতন্ত্রীদের বিরোধ মোকাবিলা করতে হয়েছে। অনেক জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। তাঁকে একবার আনাদোল অঞ্চলের গভীরে এস্কি নামক শহরে নির্বাসিত করা হয়। একবার উসকুদার এলাকার মুফতী হত্যার অভিযোগে ১৯৮২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আড়াই বছর বিচারের পর তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন।

১৯৮৫ সালে তাঁকে জনসমক্ষে আসা থেকে বারণ করা হয়। তাঁর ছাত্র, মুরীদ ও ভক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য হুমকিস্বরূপ দাবি করা হয়। দীর্ঘ মামলা চলার পর তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। এ ছাড়াও সেকুলাররা শাইখের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করে। তাঁর একান্ত শিষ্য ও মেয়ে জামাতা শাইখ খাদির আলী মুরাদ উগলুকে ১৯৯৮ সালে ইসমাঈল আগা মারকায মসজিদে হত্যা করা হয়। এরপর তাঁর বড় জামাতা শাইখ বৈরাম আলী উযদুর্ককে ২০০৬ সালে ইসমাঈল আগা মসজিদে দরস দেওয়া অবস্থায় হত্যা করা হয়। এমনকি ২০০৭ সালে খোদ শাইখ এফেন্দির গাড়িতে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ায় তিনি প্রাণে রক্ষা পান। তবে এই আঘাতের প্রভাব শেষ জীবন পর্যন্ত তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে।

শাইখ মাহমুদ এফেন্দির কফিন কাঁধে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান

শাইখ মাহমুদ এফেন্দি তাঁর ঈমানদীপ্ত সাহসী প্রচেষ্টায় সফল হয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত চেষ্টায় এবং একদল সমমনা আলেমের কষ্টসাধনায় তুরস্কে দীনদার একটি নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হয়, যারা কোরআনের হাফেয ও আমলওয়ালা আলেম, যারা তাদের এই শিক্ষা ও দীনদারিকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং শাইখের আধ্যাত্মিক প্রেরণাকে জাতির জীবনে প্রস্ফূটিত করেছেন। নকশবন্দি তরীকার শাইখ সুফি আহমদ এফেন্দি ও শাইখ আলী হায়দার এফেন্দি থেকে ফয়েজ লাভ করেন। হানাফী মাযহাবের এই সংস্কারক, মুজাহিদ আলেম, উলামায়ে দেওবন্দের সমমনা। তিনি হযরত কাসেম নানুতুভীকে জামানার মুজাদ্দিদ আখ্যায়িত করেন এবং ইসলামী কর্মতৎপরতার পতনযুগে তাঁরই পদ্ধতি অনুসরণ করে মানুষের মনে ইসলামের মহব্বত, গুরুত্ব, শিক্ষা ও আদর্শকে ধরে রাখার জীবনপণ মেহনত করেন। জনগণের অন্তরে তাঁর হাতে বপন করা ঈমান, মহব্বত ও তালীমের বীজ থেকেই পরবর্তীতে দীনের ফুল ও ফসল জন্মে। যে দীনদারী জুলুমকে চ্যালেঞ্জ করে নেফাক ও বদদীনির সাথে আপস থেকে জাতির বিশাল অংশকে রক্ষা করে। একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করে, যারা পার্থিব স্বার্থ, সম্পদ, ক্ষমতা বা দুনিয়াবি সম্মানের লোভ সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে পবিত্র অন্তর, নম্রভাষা ও সামগ্রিক তাকওয়ার দ্বারা দুনিয়ার লোভ ও বস্তুবাদী আক্রমণ মোকাবিলা করেন। অস্থায়ী জীবনের মেকি চাওয়া-পাওয়া আন্তরিকভাবেই ত্যাগ করে তারা একমাত্র আল্লাহর রাজি-খুশিকে জীবনের ব্রত করে নিয়েছিলেন। ফলে বিজয় তাঁদের পদচুম্বন করেছে।

শাইখ মাহমুদ এফেন্দি ইসলাম ও মুসলমানের জন্য বিপদের দিনে জীবন বাজি রেখে কাজ করার উত্তম নমুনা। তুর্কি সমাজের মুসলিম পরিচয় ধরে রাখা এবং তাদেরকে আবার ইসলামের সাথে একাকার করার সংগ্রামে তাঁর সকল কষ্ট, আঘাত, ত্যাগ ও সংগ্রাম আল্লাহ কবুল করেন এবং তাঁকে জান্নাতে উচ্চ আসন দান করেন।