ড. সলিমুল্লাহ খান: শিক্ষার ক্ষেত্রে ফিরে দেখা অতীত 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ১৩ ২০২১, ১৪:৫৬

সৈয়দ শামছুল হুদা: স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তির কাছাকাছি সময়ে এসে বাংলাদেশে যখন কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ও সনদের স্বীকৃতির প্রশ্ন আসলো, তখন কিছু মানুষ নড়েচড়ে বসলো। হৈচৈ করে উঠলো। হায়! হায়! এবার বুঝি জাত যায়। ঠিক এমনি সময়ে একটি মানুষের প্রচন্ড বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থণে অভিভূত হয়েছিলাম। আর সেই মানুষটি হলো ড. সলিমুল্লাহ খান। তিনি অতীতের পাতা ঘেটে, শিক্ষার চমকপ্রদ যুক্তি উপস্থাপন করে তুলে ধরলেন যে, কীভাবে? কেন কওমী সনদের স্বীকৃতি সমর্থন করেন। সেই দিন থেকেই উনার প্রতি আলাদা একটি সম্মান অন্তরে গেঁথে গেছে।

ব্যক্তিজীবনে তিনি কি আদর্শ লালন করেন, তিনি ডান না কি প্রচন্ড বাম, তিনি কি বিএনপিপন্থী নাকি আওয়ামীপন্থী এসব বিষয় ভাবনার কোন প্রয়োজন অনুভব হয়নি। মানুষটিকে মনে হয়েছে সত্যকে সত্য বলার সাহসটুকু অন্তত এই প্রচন্ড বুদ্ধিবৃত্তিক খরার সময়েও রাখেন। এতে উনার রুটি-রুজির কোন সমস্যা হবে কী না এ নিয়ে উনাকে কোন প্রকার পেরেশানিতে থাকতে দেখলাম না। ইনিয়ে-বিনিয়ে আমাদের দেশের আর দশটা বুদ্ধিজীবির মতো ছল-ছাতুরীর আশ্রয় নেননি। উনার বক্তব্যে মৌলবাদিরা উপকৃত হয়ে যাবে, পশ্চিমা বন্ধুরা নাখোশ হয়ে যাবে, নিদেনপক্ষে এপাড়ের বাম আর ওপারের রামরা ক্ষুদ্ধ হবে এমন ভাবনা তাঁর মধ্যে কাজ করেনি।

পিনাকীদের মতো আমরা এ প্রশ্ন তুলতে চাই না যে, তিনি কি আসলেই দার্শনিক, নাকি আসলেই ভালো কোন বুদ্ধিজীবি। কারণ বাংলাদেশ জটিল এক বুদ্ধিবৃত্তিক গ্যারাকলের দেশ। এখানে প্রকাশ্যে আদালতে বলা হয় “ট্রুথ ইজ নট ডিফেন্স।” সুতরাং এদেশে সত্য কথার কোন ভাত নেই। দলবাজি হলো কি না? পশ্চিমা, বিশেষ করে ওপার বাংলার স্বার্থ সুরক্ষিত হলো কি না তার ওপরই নির্ভর করে অনেক কিছু। এসবের ধার ধারেননি ড. সলিমুল্লাহ। এটাই আমার ভালো লাগার কারণ।

গত ১০জুন,২০২১ শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত নয় টায় জার্মান প্রবাসী খালেদ মহিউদ্দীন এর সাথে “ খালেদ মহিউদ্দীন জানতে চায়” শীর্ষক ধারাবাহিক ডয়চে ভেলে এর সিরিজ আয়োজনে “শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবস্থা” শীর্ষক একটি একক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনায় ড. সলিমুল্লাহ খান আলোচনায় এমন কিছু বিষয় নিয়ে আসেন, যেগুলো দেখে ইসলামী ধারার শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে ড. সলিমুল্লাহ এর ব্যাপারে ভালো ধারণাটা আরো বেড়ে গেছে।

তিনি যে বিষয়টি স্পষ্ট করেন, সেটা হলো শিক্ষার ধারাবাহিকতা অনেক প্রাচীন। আমাদের দেশের কতিপয় জ্ঞানী-গুণী, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস টানতে গিয়ে সর্বশেষ ৮শ বছর আগ পর্যন্ত গিয়েছেন। অক্সফোর্ড, ক্যামব্রীজ ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়কেই উনারা উচ্চশিক্ষার শেষ স্তর হিসেবে সাভ্যস্ত করেন। অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরিই মুসলিম বিশ্বের সোনালী দিনগুলো থেকে ধার করা। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যা যা অনুকরণ করা হয়, যে সব বিষয় অনুসরণ করা হয় তার সবকিছুই আব্বাসী খিলাফতের সময়কার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধারকরা। আমাদের দেশে যে শিক্ষ্যা ব্যবস্থা দরসে নিজামী হিসেবে পরিচিত সেটাই প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার উত্তরাধিকার। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এগুলো প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছে কি পারছে না সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।

আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিগণ অতীতে যেতে চান না। রাজনীতিবিদরা ৭১পার হতে চান না। অথচ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে যেই বঙ্গবন্ধু ৪৭এর দেশ বিভাগের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, কেন ৪৭এ দেশ ভাগ করতে হলো, কাদের অত্যাচারে সেদিন দেশটাকে এক রাখা সম্ভব হয়নি, এটা যেমন আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিরা দেশের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনায় গোপন রাখেন, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থায় বৃটিশের উদয়তো হলো সেদিন, তার আগে শত শত বছর কি এদেশের মানুষ মুর্খ ছিল? ৩টি মহাদেশ শাসনকারী উসমানী খেলাফতের ৬২৫বছরের উজ্জ্বল দিনগুলো কি মুর্খতায় ভরা ছিল? আব্বাসী শাসনামলের ৫শ বছরের আবিস্কার, জ্ঞান-গরিমার ঔজ্জ্বল্য সবকিছুই কি তুচ্ছ বিষয়? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এদেশের কিছু মানুষ পাশ্চাত্যের গোলামী করতে গিয়ে তারা মুসলমানদেরকে অবজ্ঞা করে। পাশ্চাত্যের শিখানো শব্দ “ডার্ক অব এজ” তথা ওদের অন্ধকার যুগকে মুসলমানদের সোনালী সময়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায়। পাশ্চাত্যের শিখানো বুলির বাইরে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিরা বের হয়ে আসতে পারে না।

ড. সলিমুল্লাহ খান তিনিই কি প্রথম ব্যক্তি যিনি এসব উচ্চারণ করছেন? এর আগে কি এসব বিষয় কেউ বলেনি? বিষয়টি আসলে এমন নয়। এগুলো বহুবার, বহুভাবে আলোচিত হয়েছে। অসংখ্য বই-পুস্তক আছে। আমাদের প্রিয় গবেষক মুসা আল হাফিজ এসব বিষয়ে লেখালেখি করছেন। বই বের করেছেন। কিন্তু উনার ক্ষীণ আওয়াজটি বর্তমানের যারা মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে নাক ছিটকায় তাদের পর্যন্ত পৌঁছায় না। কিন্তু ড. সলিমুল্লাহ এর যেহেতু ওদেরই ঘরানার, ওদেরই শিক্ষায় শিক্ষিত, সেহেত তাঁর কথাটা ওদের গায়ে খুব করে লাগে। আর এই লাগাটাই আমাদের কাছে আনন্দের জায়গা। কারণ ওরা আমাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যর দৃষ্টিতে দেখে। মূলত: আমাদের শিক্ষাটাই অতীত থেকে চলে আসা শিক্ষা ব্যবস্থার ধারাবাহিকতার অংশ। যদিও আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। অনেক ত্রুটি মিশে আছে, কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, এটা কোন শিক্ষা ব্যবস্থাই না। এটাকে একেবারে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে।

ধন্যবাদ ড. সলিমুল্লাহ খানকে। তিনি সত্যকে সাহসের সাথে তুলে ধরেছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষার মান নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের প্রচুর ঘাটতির কথা বলেছেন। অথচ কেউ এ কথা বলে না যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরণের অসংগতি রয়েছে, ঘাটতি রয়েছে এগুলো পূরণে এসব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হোক। কিন্তু কিছু মানুষ ঠিকই সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথে মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে কটাক্ষ করে। এগুলো বন্ধ করে দিতে বলে। মূলত: ওরা জ্ঞানপাপি।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে মাদ্রাসা শিক্ষায় আধুনিকতাকে আপন করে নিতে হবে। প্রযুক্তির উন্নতির এই সময়ে আমাদেরকে হাজার বছর পেছনে পড়ে থাকলে হবে না। কোন এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যে ধরণের জড়তা ঝেঁকে বসে, এমনিভাবে মাদ্রাসাশিক্ষা প্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে জড়তা পেয়ে বসেছে। এগুলো ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। নতুন বসতিস্থাপনকারীদের মতো পাশ্চাত্য শিক্ষা আমাদের ঘাড়ে যেভাবে সওয়ার হয়েছে তা থেকে উত্তরণে নতুন ও প্রাচীন শিক্ষার সুমধুর সমন্বয় সাধন করেই মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করতে হবে। যুগ-চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সত্য ও সঠিক বিষয়টা বুঝার তৌফিক দান করুন।