টিপ ও হিজাব: আদর্শিক দ্বন্দ্ব ও প্যারেন্টিং 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

এপ্রিল ১৩ ২০২২, ১৯:৫৯

মুফতি ইউসুফ সুলতান: নব্বই শতাংশ (কমবেশি) মুসলিমের এ দেশে গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে হিজাব-বোরখা, দাড়ি-টুপি-পাগড়ি, জুব্বা-পাঞ্জাবিকে ঘৃণার বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। শুরুটা হয়ত ছিল নিছক সেকেলে বলে অভিহিত করা, নাটক-সিনেমা-উপন্যাস ও মিডিয়ায়। এরপর বুলিং-র‍্যাগিং-ট্রলের উপকরণ, এবং পরে এক্সট্রিম লেভেলে গিয়ে জঙ্গিবাদ, স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করা – এ সবই হয়েছে।

এ দেশে গত দুই-তিন দশকের প্রজন্মের কেউ দাড়ি-টুপি, জুব্বা-পাগড়ি বা হিজাব-বোরখা পরেছে কিন্তু বুলিং বা জুলুমের শিকার হয় নি, এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না। কেউ যদি বলেন যে তিনি এসবের শিকার হন নি, তিনি হয় ভুলে গেছেন, নতুবা অস্বীকার করছেন।

আমরা যারা মাদ্রাসায় পড়েছি, তারা তো সম্ভবত বুলিং লিস্টে প্রথমে থাকব। পরিবার, প্রতিবেশী, এলাকাবাসী, রাস্তাঘাট, সমাজ, রাষ্ট্র – কোথায় বুলিং-জুলুম হয় নি। যখন তখন জঙ্গিও আখ্যা দেয়া হয়েছে, রাষ্ট্রের সব লেভেল থেকে। আমার কিশোর বয়সের সময়, দেশে তখন বাংলাভাই আতঙ্ক চলছে, এমনও হয়েছে যে বাসে উঠেছি, পাশের যাত্রী সরে গিয়েছেন, হয়ত আমি বোমা বহন করছি ভেবে।

অসংখ্য কনফার্মড ফার্স্ট হ্যান্ড তথ্যের ভিত্তিতে বলছি, এ বুলিং চলে অফিস, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও। শিক্ষক-শিক্ষিকা, সহকর্মী-বস ও বন্ধু-বান্ধব সব লেভেল থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো এক্সট্রিম র‍্যাগিংয়েও পরিণত হয়। কেউ মরলে সংবাদ হয় হয়ত, নতুবা কেউ জানেও না।

তো, একটি সিস্টেমেটিক প্রসেসের মধ্য দিয়ে এই প্রজন্মকে বার্তা দেয়া হয়েছে যে, হিজাব-দাড়ি-জুব্বা এসব সেকেলে, জঙ্গিবাদ, পরাধীনতা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে ওয়েস্টার্ন পোশাক, চিন্তাধারা, লাইফস্টাইল -এসব আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ইত্যাদি। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন অদ্ভুত বিজ্ঞানচর্চা আছে কিনা জানা নেই। আল্লাহর রহমতে সেই দুই মাস বয়স থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে থাকার ও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ, এমন অদ্ভুত বিজ্ঞানীদের দেখা মেলে নি, আমারই ব্যর্থতা হয়ত।

নানা কালচার ও ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটা রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি, অথচ আমাদের দেশে সবসময় ঘৃণার চাষ করা হয়।

আমরা এখন একটা আদর্শিক দ্বন্দ্বের মাঝে আছি। যেখানে ন্যারেটিভটা হলো, হিজাব-দাড়ি-টুপি এগুলো শৃঙ্খল ও বাধ্য করা, ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, যদিও কেউ স্বেচ্ছায় পরে। আর পর্দাহীনতা, অশ্লীলতাই স্বাধীনতা, এবং একমাত্র স্বেচ্ছায় করার মতো বিষয়। মানে কেউ গান গাইলে বা অশ্লীলতা করলে সে স্বেচ্ছায় করছে, কিন্তু কুরআন পড়লে বা শ্লীলতা গ্রহণ করলে তাকে কেউ বাধ্য করছে।

মানে আপনার শিশুকে হিজাবের ও নামায-রোজার কথা বলবেন, এর অর্থ তাকে বাধ্য করছেন। কিন্তু গান-নাচ-অভিনয় শিখতে বলবেন, তা তাকে তার স্ব-ইচ্ছা ডেভেলপ করতে সহযোগিতা করছেন। কাজেই, তাকে ইচ্ছা বিরুদ্ধ কিছু করতে দেয়া ঠিক না, মানে নামায-রোযা, হিজাব করতে বলা ঠিক না, সে নিজ থেকে করলে করবে, না করলে নেই। কিন্তু তাকে অবশ্যই নাচ-গান-অভিনয় শেখাবেন, সেটা সমস্যা নেই।

মানে, ইচ্ছা ও পছন্দের নামে শিশু মনে ইসলামবিরোধী ন্যারেটিভ ঢুকিয়ে দিবেন, তা তার ইচ্ছার অনুকূল বলে ঠিক হবে। আর দ্বীন বিষয়ে কিছু বাধ্য করবেন না, খবরদার।

প্রিয় মুসলিম অভিভাবকবৃন্দ, আপনি-আপনারা আল্লাহর দেয়া আমানাহ রক্ষা করছেন। সন্তান আপনাদের হাতে আমানাহ। আশা করি সময়ের এ আদর্শিক দ্বন্দ্ব উপলব্ধি করে আপনার প্যারেন্টিং স্ট্রাটেজি নির্ধারণ করবেন। আপনার পরের প্রজন্ম আল্লাহকে সিজদা করবে না তাঁকে অস্বীকার করবে, তা নির্ধারণ করবে আপনার আজকের প্যারেন্টিং।

আল্লাহ তায়ালা সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।