জামায়াতের জোট ত্যাগ: কার কী লাভ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ২৮ ২০২২, ২০:২৬

সৈয়দ শামছুল হুদা: দীর্ঘ টানাপোড়েন শেষে জামায়াত নিজ থেকেই জোট ত্যাগের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে। এটা নিয়ে দিনব্যাপী নানা পর্যালোচনা হচ্ছে। জামায়াতের বর্তমান মুহতারাম আমীর ডা. শফীকুর রহমান সাহেব একটি ঘরোয়া আলোচনায় এটা প্রকাশ করেছেন। এটা জামায়াতের নিজস্ব পলিসি। প্রতিটি দলেরই নিজস্ব পলিসি থাকে। এর আগে জামায়াত বগুড়া জেলায় তাদের নির্বাচনী সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করে এমন কিছুরই পূর্বাভাস দিয়েছিল। যদিও এখনো পর্যন্ত নির্বাচনের কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি।

জামায়াতের আমীর সাহেব যে অভিযোগটি এতদিন পর প্রকাশ করলেন, সেটা নিয়ে কিছু কথা থেকে যায়। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, বিএনপির সাথে জোট ২০০৬সালের ২৮অক্টোবরই শেষ হয়ে গিয়েছে। সেদিন জোটবদ্ধভাবে কেউ কারো সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। দীর্ঘ ১৬বৎসর পর উপলব্দি হলো যে, বিএনপি জোটের মর্যাদা রক্ষা করেনি। এত জল ঘোলা হওয়ার পর তাদের এ সুর অনেক কিছুর ইঙ্গিত করে। জোটের সাথে আর জামায়াত নেই এ কথাটার গভীর তাৎপর্য রয়েছে।

জামায়াতের জোট ত্যাগের সময় এবং প্রেক্ষিতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক যে মুহুর্তে দেশে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে, যখন খুব শীঘ্রই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করবেন, আর সেখানেই চূড়ান্ত হবে আগামী নির্বাচন কোন মডেলে হবে, কীভাবে পরবর্তী সরকারকে বৈধপথে ক্ষমতার দীর্ঘায়ণ সম্পন্ন হবে।

মানুষ যখন দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে হা-পিত্যেশ করছিল, যখন একটি কাঙ্খিত পরিবর্তনের জন্য স্বপ্ন বুনছিল, তখন জামায়াতের নিজ উদ্যোগে জোট ত্যাগের ঘোষণা জামায়াতকে সাময়িক সুবিধা এনে দিবে বটে, সামগ্রীকভাবে ক্ষতি হবে দেশ ও রাষ্ট্রের। জামায়াত এর মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর মতো নিরাপদে রাজনীতি করার সুযোগ পাবে। হয়তোবা নিবন্ধন ফিরে পাবে। নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করারও সুযোগ পাবে। বিনিময়ে আওয়ামীলীগ সম্ভাব্য ক্ষমতার প্রতিদ্বন্ধি বিএনপিকে নাস্তানাবুদ করে দিবে, নির্বাচনী মাঠ থেকে একেবারেই উচ্ছেদ করে দিবে। আগামী নির্বাচন বাহ্যত প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ হবে। বিএনপিকে হাতে গোনা কয়েকটি সীট দিয়ে সবাইকেই খুশি করা হবে।

জামায়াত কেন ঠিক এই মুহুর্তে জোট ভাঙ্গার দায়টা নিতে গেলো? এটা কি ঠিক সেই ৯৬এর পুনরাবৃত্তি? জামায়াত যদি মনে করে থাকে ২০০৬সালেই জোটের কার্যকারিতা শেষ হয়ে গিয়েছে, তার চূড়ান্তরূপ দিতে এত দীর্ঘ সময় নিতে হয়? নাকি পর্দার অন্তরালে এখানে অন্যকিছু আছে সেটা সময় আসলেই প্রকাশ হবে। জোট ত্যাগের এ ঘোষণার সাথে বড় ধরনের রাজনৈতিক ম্যাকানিজম আছে সন্দেহ নেই। ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য ঠিক এই মুহুর্তে এতটুকুই দরকার ছিল যে, জামায়াত বলুক তারা বিএনপি জোটে নেই। বাকীটা যা করার সেটা তারাই করবে। জামায়াতের এই ঘোষণার মাধ্যমে বিরোধী দলের মধ্যে বিভক্তির ষোল কলা পূর্ণ হলো। দেশে যারা নির্বাচনী ম্যাকানিজম করে, বিশেষ করে যারা লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে নানাভাবে কলা-কৌশল তৈরি করেন তাদের জন্য এতটা অনুকূল পরিবেশ আর হতে পারে না। এটাকে লীগ সরকারের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে।

বিএনপির সামনে পাশ্চাত্য শক্তি ক্ষমতার মূলা ঝুলিয়ে রেখেছে। তারা এটা বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, যদি ইসলামপন্থীদের দলের চারপাশ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারো, তাহলে তোমাদের ক্ষমতার পথ মসৃণ করতে আমরা চেষ্টা করতে পারি। বাংলাদেশের প্রথমালো গংরা এটা খুব করে আশা করছিল। তারা বিএনপিকে তখনই মানবে, যখন তারা ইসলামী দলগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে। বিএনপি সে পথেই হেঁটেছে। বিশেষ করে বর্তমান মহাসচিব ২০১৮সালের নির্বাচনী সুযোগটা হারিয়েছে ড. কামালের ফাঁদে পা দিয়ে। আর এবার গণতন্ত্র মঞ্চ, বামধারার বন্ধুদের নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তারা এখনো বুঝতেই পারেনি, আসলে বিএনপির ক্ষমতায় মূল সমর্থক শক্তিটা কারা? এরা উপস্থিত কিছু শোডাউন দেখে ভাবছে আমাদের কোনো ইসলামপন্থী শক্তির প্রয়োজন নেই। তাদের থেকে একে একে সবগুলো দলই বিদায় নিচ্ছে। তারা বরাবরের মতোই নিরবতা পালনকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মনে করেছে।

আজকের এই দিনটি আওয়ামীলীগ সরকারের জন্য উৎসবের দিন। এতটা নির্ভার হতে পারবে লীগ মনে হয় কিছুদিন আগেও ভাবেনি। এখন ভারত সফরে তারা ফুরফুরে মেজাজেই থাকবে। জামায়াতের উচিত ছিল চুপ থাকা। এতদিন যেহেতু তারা বিএনপি থেকে কোনো আনুকূল্যই পায়নি, আগামীতেও পাবে না ধরে নিয়ে নিজেদের মতো করেই আগাতে থাকা। এ ঘোষণাটা জামায়াতের সাময়িক মুনাফা এনে দিবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি রাজনৈতিক ও আদর্শিক ক্ষতির মুখোমুখি তাদের হতে হবে। ইসলামী আন্দোলন যে সুবিধাটা রাজনীতিতে পেয়েছে, সেটা যদি জামায়াত পায়ও, তাহলেও তাদের আদর্শিক ক্ষতি। আর যদি সে সুযোগ না পায়, তাহলেতো আমছালা সবই শেষ। রাজনীতিতে আদর্শ নিয়ে টিকতে পারা কঠিন পরীক্ষা। এতদিন যেহেতু তারা চুপ ছিল, আর কটা দিন চুপ থাকলে উপকার না হলেও ক্ষতি হতো না। কিন্তু এখন তারা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে বটে, সেটা হবে আত্মঘাতি।