চাই গবেষণামনস্ক আলেম

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ১৭ ২০১৯, ২১:১৪

মুসা আল হাফিজ

ভালো আলেম। লেখালেখি করেন। ইনবক্সে জানতে চাইলেন, ইফতা ও আদব পড়ার পরেও আমার জন্য বুহূস বা গবেষণা বিভাগে পড়া ও কাজ করা কেন জরুরী?

দরকারী প্রশ্ন। বিস্তারিত জবাব দেয়া যায়নি। সংক্ষেপে যা বলেছিলাম, তা হলো, আপনার জন্য অন্যদের চেয়ে অধিকতরো জরুরী। মিল্লাতের মহান আলেমদের যারা জামানার স্রোতে পরিবর্তন এনেছেন, তারা সমকালিন চিন্তার সবগুলো কক্ষপথে বিচরণ করেছেন। গবেষণার শক্তি, আবেদন ও বিপুলতায় তারা কালের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে সক্ষম হয়েছেন।

ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর রহ. কথাই ধরুন। তাফসীরের উপর বিশেষজ্ঞ কোর্স যাকে বলে, তা তিনি করলেন, হাদীস, ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য ও ন্যায়শাস্ত্রের উপর সম্পন্ন করলেন বিশেষজ্ঞ কোর্স। সমরকন্দের আমীর তাকে সেখানকার জামেয়ার অধ্যাপক হবার অমন্ত্রণ জানালেন। রাযী জবাবে জানালেন, ’শ্রদ্ধা। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার প্রস্তুতি আমার আছে। কিন্তু আমার দৃষ্টি আরেকটু দূরে। চিন্তার যে ইন্দ্রজাল ও অবক্ষয় আমার জাতিকে পচন ও পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমার কাজ করার আছে। এতোদিনের পাঠে এটি বুঝেছি। এখন বুঝকে বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছি।‘

রাযী তার সমকালের দুইটি গবেষণাগারের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন। অর্জিত জ্ঞানকে জীবন্ত অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন করার কাজ করেন। চিন্তা ও অনুধ্যানের বৈশ্বিক সকল ধারাকে আত্মস্থ করেন। হতে পারতেন একজন ভালো শিক্ষক, হলেন মহান দার্শনিক ও কালজয়ী মনীষী।

রাযীর মধ্যে এলো এতো ব্যাপকতা, যা বিস্ময় জাগায় যে কোনো জ্ঞানার্থীর মনে! উম্মাহের জ্ঞান ও চেতনালোকের প্রতিটি গলিতে আলো ফেললেন। সেকালে মুসলিম মিল্লাতের যতগুলো শিক্ষিত শ্রেণী আছে, যতগুলো চিন্তাশিবির আছে এবং মুসলিমদের বাইরের যতগুলো চিন্তাচক্র আছে, সব জায়গায় করেছিলেন আলোকসম্পাত।তার গ্রন্থাবলীর বিষয় বৈচিত্র দেখুন। রাযীর গ্রন্থাবলীর একটি বিষয়তালিকা দিয়েছেন প্রাচ্যবিদ ব্রোকেলম্যান। গ্রন্থাবলীকে তিনি ১৩ টি বিষয়শিরোনামে বিভক্ত করেন। তা হচ্ছে-
ইতিহাসে ২ টি, ফিকহে ৩ টি, কুরআন সম্পর্কিত ৪ টি, আকাইদ ৫ টি, দর্শন ৬ টি, জ্যোতির্বিদ্যা-৭ টি, হস্তাক্ষরবিদ্যা ৮ টি, অলঙ্কারশাস্ত্র- ৯ টি, বিশ্বকোষ ১০ টি, মেডিসিন- ১১ টি, চেহারা বিচার করে চরিত্র নির্ণয়বিদ্যা-১২ টি, রসায়নশাস্ত্র-১৩ টি, খণিজবিদ্যা-১৪ টি!
আলী আসসামী আন নাশ্বারের হিসোবে রাযীর গ্রন্থাবলীর বিষয় ও সংখ্যা নিম্নরূপ- তাফসীর- ৫টি, মেটাফিজিক্স ৪০ টি, দর্শন-২৬ টি, ভাষা ও সাহিত্য – ৭টি, ফিকহ ও উসূলে ফিকহ- ৫ টি, মেডিসিন- ৭টি, জ্যামিতি- ৫টি, ইতিহাস-২ টি!
ব্রোকেলম্যান ও নাশ্বার উভয়েই কবুল করেছেন, প্রতিটি বিষয়ে রাযীর চিন্তাধারা ছিলো সমকালিনতা অতিক্রমী। ইসলামের জন্য তিনি যে মহান কাজ করেছেন, তা হয়তো হতো না জামানার প্রতিটি শ্রেণীকে সম্বোধন করার প্রজ্ঞা ও গবেষণা না থাকলে।

রাযীর এ চিন্তাকর্ম ছিলো বৈপ্লবিক। প্রতিটি ঘরাণায় নাস্তিক্য, মুতাজিলী দর্শন, ধর্মহীনতা, গ্রীকভাবধারা ইত্যাদির পণ্ডিতদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। বিশ্বাসের পক্ষে চিন্তার গতিকে করে চালিত। ব্রোকেলম্যান স্বীকার করেছেন, তা না হলে মুসলিম সভ্যতা আরেকবার যৌবন নিয়ে জেগে উঠতে পারতো না!

রাযী চলে গেলেন। সময় বয়ে গেলো। কয়েক শতকের মধ্যেই মুসলিমরা জ্ঞান ও গবেষণার সেই প্রাধান্যের জায়গা হারিয়ে ফেললো। একজন রাযী কিংবা গাযালী কী রেখে গেছেন, তা দিয়ে কী হতে পারে, সেটাও ভুলে গেলো।

কিন্তু এগিয়ে এলো ইউরোপীয়রা। তারা আপন জাতিকে জাগাবে বলে, জীবনের আগুনে জ্বালাবে বলে চর্চা করতে থাকলো রাযীদের। রাযীগবেষণার জন্য নিবেদিত হলেন অনেকেই। তার শরহুল ইশারাত সম্পাদনা করেন ফ্রগেট, ছাপা হয় কনস্টান্টিনোপোল থেকে, তার মুহাসসালু আফকারিল মুতাকাদ্দিমীন ওয়াল মুতাআখখিরিন মিনাল উলামা (প্রাচীন ও আধুনিক যুগের পণ্ডিত, দার্শনিক ও ন্যায়বিদদের মতবাদের সারসংক্ষেপ) ইউরোপ থেকে ছাপা হয় রাযীর নাম ছাড়াই, তার তালখিসুল মুহাসসাল নিযে রচিত হয় বহুগ্রন্থ, হরটন সাহেব দুই খণ্ডে লিখেন এর সারংক্ষেপ, নাম দেন- Dia Philosophischen Ahsichten von Razi And Tusi অনুবাদে অসংখ্য ভুল ও ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা বইটিকে লাঞ্চিত করে। তার মুনাজারাতে আছে আইনী ও দার্শনিক বিতর্কসমূহ, বইটির ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেন Kraus 1, তার কিতাবুল ফিরাসা Physiognomy শাস্ত্রের ভিত্তিস্থাপক গ্রন্থ। ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়ে বইটি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এখনো তার মূল কপি আছে ক্যাম্রিজ ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরী, ব্রিটিশ মিউজিয়াম ইত্যাদিতে।
মাত্র কয়েকটি বইয়ের তথ্য দিলাম। শর্টার ইনসাইক্লোপোডিয়া অব ইসলামে Article on Razi প্রবন্ধে ক্রমার্স সাহেব পাশ্চাত্যে রাযীগবেষণার দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। দেখিয়েছেন আজ অবধি পশ্চিমা বিশ্ব রাযীর কাছ থেকে জ্ঞানজগতে শ্রেষ্ঠত্বের উপাদান আহরণ করছে। এ জন্য আজো চলমান রাযীগবেষণা।

শর্টার পরিহাসের ভাষায় বলেছেন, একজন রাযী তার জাতিকে আলোকময় করবেন বলে যে গবেষণাসম্পদ রেখে গেলেন, উত্তরাধীকারীরা সময়ের ব্যবধানে একে গুরুত্বপূর্ণ মনেই করতো না। তারা রাযীকে শ্রদ্ধা করতো মুফাসসির ও মুতাকাল্লিম হিসেবে। গবেষণা করে জাতিয় সঙ্কট উত্তরণ তাদের কাছে গুরুত্ববহ ছিলো না। রাযীর তাফসীর থেকে তারা পরস্পরে পরস্পরের প্রতিপক্ষকে আক্রমণের দলিল তালাশ করছিলো।
এ দিকে পশ্চিমা দুনিয়া আপন আলোকায়নের ভিত গড়ে নিচ্ছিলো নিরব পরিচর্চায়!

এ বর্ণনার সারকথা হচ্ছে, সম্ভাবনাময় আলেমদের স্বপ্নকে রাযীর মতো করে দেখতে হবে। প্রস্তুতি নিতে হবে তেমনি করে। মনে রাখতে হবে, প্রজ্ঞা-গবেষণা ও জাতিয় দায়পালন আলেমের অগ্রাধিকার। একে যদি ধরে রাখতে না পারেন, আপনার সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অপর জাতি আপনাকে পরাজিত করবে।