চরফ্যাশনে নিখোঁজ জেলে পরিবারগুলোর আর্তনাদ শোনার কেউ নেই

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ২৯ ২০২০, ২১:৩৯

চরফ্যাশন উপজেলা প্রতিনিধি: ভোলা-চরফ্যাশন উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন মুজিবনগর। সমুদ্র উপকূলবর্তী এই ইউনিয়নের চর মনোহর গ্রামে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় কান্নার শব্দ। বুক ফাটা আহাজারি আর শিক্ষা বঞ্চিত ও অনাহারে থাকা অসংখ্য শিশু আর্তনাদ৷ সমুদ্রে মাছ শিকার করতে গিয়ে একমাত্র উপার্জনকারী কে হারিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করা পরিবারগুলোর এখন আর খবর রাখে না কেউ৷ পাইনি কোন সরকারি-বেসরকারি অনুদান৷ সরকারি বিভিন্ন অনুদান, বিধবা ভাতা, আর বসবাসের জন্য একটু সরকারি জমি বন্দোবস্তের আকুতি জানিয়েছেন পরিবারগুলো৷

চলতি বছরের অগাস্ট মাসে এই গ্রামের ৭ জন জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। সকলেই প্রতিবেশী এবং একে অপরের আত্মীয়। নিখোঁজ এই মানুষগুলোর স্বজনদের আহাজারিতে গ্রামের বাতাস এখনো ভারী হয়ে আছে।

অগাস্ট মাসে সমুদ্রে ইলিশ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবে ১৭ জন জেলের মধ্যে ১০ জন জীবিত ফিরে আসতে পেরেছিলেন। বাকিরা ফেরেননি। সে দিন প্রবল ঝড়ের মুখে তুফানের সঙ্গে যুদ্ধ করে ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে জীবিত ফিরে আসাদের মধ্যে আবদুল মোতালেব ফরাজী একজন। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সমুদ্রের অবস্থা খারাপ দেখে আমরা কিনারের দিকে ফিরছিলাম। হঠাৎ পাশ থেকে আসা প্রবল ঢেউয়ে ট্রলার উল্টে যায়। ট্রলার ধরে কয়েকজন বাঁচার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ট্রলার থেকে যারা ছিটকে গেছে তারা আর ফেরেনি।

ফিরে না আসা, অথবা লাশ হয়ে ফিরে আসা দের মধ্যে আলমগীর হোসেন (৩৭), জাকির হোসেন (৩৫), সামসুদ্দিন (৪৮), আবু কালাম ফরাজী (৪২), বাবুল হোসেন (৪০), আবু কালাম ফরাজী (৪৫) ও আলী আজগর (২৫)- প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে দেখা যায় এক নির্মম দৃশ্য৷ একমাত্র উপার্জনকারী কে হারিয়ে স্বাভাবিক হতে পারিনি কেউ৷ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাবে প্রতিটি পরিবার ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কে নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন৷ প্রথমদিকে অনেকেই কিছু না দিলেও সমবেদনার জন্য গিয়ে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করতে দেখা গেলেও এখন আর কেউ তাদের খবর রাখেনা৷

নিখোঁজ জেলে জাকির হোসেনের বাড়িতে পা রাখতেই ঘরের ভেতর থেকে বিলাপ কানে আসে। ঘরে ঢুকে দেখি মুখ চেপে কাঁদছেন তার স্ত্রী হাসিনা বেগম৷ জাকিরের রেখে যাওয়া ৩ লাখ টাকা ঋণ কিভাবে শোধ করবেন স্ত্রী হাসিনা জানেন না। তিন তিনটি কন্যা সন্তান তাদের। বড় মেয়ে কমলা বিয়ের যোগ্য। অন্য দু’জনের মধ্যে লামিয়া ও সিনথিয়ার বয়সও কম নয়৷ হাসিনা বেগমের এলোমেলো নড়বড়ে দুই কক্ষের ঘর। এরই মধ্যে গাদাগাদি করে থাকেন সবাই। তিন মেয়ের পরিধানকৃত পোশাকের মধ্যে অসংখ্য সেরা তালির চিহ্ন৷ মাথার চুল গুলো তৈলহীন ফ্যাকাশে৷ এমনটা শুধু মৃত জাকির হোসেনের পরিবারেই নয় প্রতিটি পরিবারে একই অবস্থা বিরাজমান৷

খানিক দূরে বেড়িবাঁধের পাশের ছোট্ট একটি ঘরে থাকতেন আরেকজন নিখোঁজ জেলে আবু কালাম ফরাজী। ঘরের ভেতর থেকে কালামের স্ত্রী রোকেয়া বেগম জানতে চেয়েছেন কে আপনি? কেন এসেছেন? আমার কোন উত্তর ছিল না তারপরেও জানতে চেয়েছি কেমন আছেন? রোকেয়া বেগম তার ৭ছেলে-মেয়ে নিয়ে এক করুণ গল্প শুনিয়েছেন৷ তাঁর গল্পের সারাংশ ছিল খুদার জালা, সন্তানদের মানুষ করতে না পারা, মেয়েদের বিয়ে দেয়ার চিন্তা, বসবাসের উপযোগী একটি ঘর নির্মাণ আর স্বামী হারানো বেদনা৷

আজগরের বাবা মহিউদ্দিন জানালেন, ছেলের শোকে অনেক দিন ইলিশ ধরা বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু পেট তো মানে না ফলে তাকেও আবার ফিরে যেতে হয়েছে ইলিশের নৌকায়। এখন আর তিনি সমুদ্রের নোনা জলে মাছ খোঁজেন না, ছেলেকে খোঁজেন- যদি একবার পাওয়া যায়।

চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার জানান, আমরা মন্ত্রণালয়ে নিখোঁজ ২১ জেলের তালিকা পাঠিয়েছি কিন্তু মাত্র এক পরিবারের জন্য ৫০ হাজার টাকা এসেছে৷ আশা করি অতি শীঘ্রই বাকিদের টাকা আসবে৷

শুধু চর মনোহরেই নয়, গত বছর চরফ্যাশন জিন্নাগড় ইউনিয়ন ৯নম্বর ওয়ার্ড উত্তর মাদ্রাজ গ্রামেও এমন আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। নিখোঁজ এবং লাশ পেয়েছেন, এমন কয়েকটি পরিবারে গিয়ে প্রায় একই দৃশ্য চোখে পড়েছে৷

ভোলা-চরফ্যাশন উপকূলে প্রায় এক লাখেরও বেশি জেলে আছে। এদের অধিকাংশই ছোটবেলা থেকেই এ পেশায় যুক্ত। ফলে মাছ ধরা ছাড়া অন্য কোন পেশায় যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এদিকে নদী, সমুদ্রে যেতে আগের চেয়ে ঝুঁকি বেড়েছে। নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন জেলেরা। বৈরী আবহাওয়ায় সাগরের আচরণ হটাৎ হটাৎ বদলে যাওয়ায় জেলেদের জীবনও আজ বিপর্যস্ত। ঝুঁকির এই পেশা যেন ক্রমেই অনিশ্চিত এক পেশায় পরিণত হচ্ছে।