গল্পকারের মৃত্যু

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ২৬ ২০১৮, ০৫:১৫

সাইফ রাহমান ● ছেলেটা খুব ভালো লেখে। গল্প লেখায় পটু। অসাধারণ সব গল্প তৈরি করে। অসংখ্য ভক্ত তার গল্পের। ছেলে-মেয়ে সবাই। কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়। গল্পের চরিত্রে শেষের দিকে কাউকে বাঁচায়, কাউকে মারে। যখন মারে, এমন অবস্থা হয়, চোখের পানি আটকানো একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। পাঠককুল এভাবেই তার লেখা পড়ে আনন্দ পান। একটা মজা অনুভব করেন।

একটার পর একটা গল্প লিখতেই থাকে গল্পকার। অবিরত। পাঠকের প্রেরণায় উৎসাহ পায় সে। গল্পগুলো পাঠকদেরও এত ভালো লাগে যে, গল্পকারের প্রতি তাদের আলাদা একটা ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেল। গল্পকার কোথাও গেলে, তার পাঠকরা যদি জানতে পারে তবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। প্রিয়গল্পকারের সাথে একটু পরিচিত হয়– আপনি গল্পকার তাহসীন? আপনার গল্পগুলো না খুব ভালো লাগে! ঠিক এরকম করে অনেক লোক গল্পকার তাহসীনের ভক্ত। বিশেষ করে বয়েসে যারা তরুণ, সবাই।

একদিন একটা গল্প লিখলো গল্পকার তাহসীন। বোনের আদর-সোহাগ নিয়ে। খুব চমৎকার। আবেগে অনেকের চোখে পানি চলে এসেছিলো। বোন কী জিনিশ, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। যাদের বোন নেই তাদের ভগ্নিবঞ্চিত হৃদয়ে হাহাকার উঠেছিল– আহ! যদি আমার একটা বোন থাকতো, কী আদর না পেতাম! সাড়াজাগানো এই গল্পটি জেসমিনকেও ছুঁয়েছিল খুব করে। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী জেসমিন। জেসমিনের কোনো ভাই নেই। ভাইয়ের আদর-সোহাগ পায়নি কখনো। একটা ভাইয়ের জন্যে জেসমিনের মনটা সারাক্ষণ হাহাকার করে। বোনকে নিয়ে লেখা এই গল্প পড়ে গল্পকারের প্রতি তারও আলাদা একটা আগ্রহ তৈরি হয়- আমার ভাই নেই। যদি আমার ভাই থাকতো, তবে তো এভাবেই আদর করত আমাকে। ঠিক তার মত করে ভালোবাসতো। গল্পে যেভাবে আছে, ঠিক সেরকম। এই আগ্রহ থেকেই গল্পকারের ফেসবুক ইনবক্সে একদিন নক করে জেসমিন। প্রিয়গল্পকারের সাথে চ্যাট করতে ভালোই লাগে তার।

এরই মধ্যে একদিন এক সাহিত্যপ্রোগ্রামে গল্পকারের সাথে দেখা হয়ে গেল জেসমিনের। চোখের সামনে স্বপ্নের মানুষকে দেখে অপলক তাকিয়ে রইল সে। যেন বহুকাল ধরে চেনে এই মানুষটাকে। অনেক অনেকবার তার সাথে কথা হয়েছে। একসাথে কোথাও ঘোরা হয়েছে। আড্ডা দিয়েছে খুব। মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্পও করা হয়েছে। কিন্তু তাহসীন তাকে চেনে নি প্রথমে। সে নির্বিকার। পরে যখন পরিচয় পেল, স্বাভাবিকভাবেই তার একটা আকর্ষণ তৈরি হয়ে গেল। জেসমিনের সাথে বেশ আড্ডাময় একটা বিকেল কাটাল তারপর। নিজের অজান্তে অল্পতেই এভাবে ঘনিষ্ট হয়ে গেল একজোড়া তরুণ-তরুণী।

রাত দু’টো বাজে। তাহসীন তখনও লেখার টেবিলে। গভীর মগ্নতায় ডুবে আছে একটা গল্প নিয়ে– অমাবস্যার রাতে নন্দিনী রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে সামনে দেখলো একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে আগুনের স্ফুলিঙ্গ! দাউদাউ করে জ্বলছে। সামনে আসতে থাকলো। ঝাপটা মেরে ধরবে… এই পর্যন্ত লেখার পর হঠাৎ তাহসীনের ফোন বেজে উঠল– ক্রিং ক্রিং ক্রিং…। রিসিভ করল সে। ওপাশ থেকে ভেসে এল একটা মেয়েলি কন্ঠ– হ্যালো।

-জি, কে বলছেন?

-আমি… – আমি মানে? এটা কোনো পরিচয় হলো? নাম বলুন।

-জেসমিন। -অহ আচ্ছা! স্যরি! ভালো আছেন আপনি?

-জি ভালো। আপনি ভালো আছেন?

– আলহামদুলিল্লাহ্‌…।

এই শুরু…। এরকম করে প্রায় প্রতিদিন। টুকটাক কথাবার্তা। রাতে যখন লেখা শুরু হয়, ঠিক তখনই ফোনের ক্রিং ক্রিং। তারপর কথা। তাহসীন কথা বলতে অপারগ। সে লেখায় মগ্ন। কিন্তু আকর্ষণ গানে। জেসমিনের। চমৎকার গাইতে পপারে জেসমিন। জেসমিন যখন গান শুনায়, তাহসীনের দেহমনে কেমন এক শিহরণ জেগে ওঠে। এই কণ্ঠটাই তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। “একটার পর একটা গান। রাতের পর রাত। চলতে থাকে এভাবেই। ধীরে ধীরে জেসমিনের প্রতি তাহসীনের আগ্রহ বাড়ে। একটা টান অনুভূত হয়। খাওয়া দাওয়া শেষে যখন তাহসীন রুমে আসে, লেখার টেবিলে বসে নিজেকে একা একা অনুভব করে, তখন সে নিজেই জেসমিনকে ফোন দেয়। চলে সারারাত আলাপ। একপর্যায়ে প্রেম। দু’জন দু’জনকে ছাড়া বাঁচবেই না এমন পরিস্থিতি। এদিকে তাহসীনের লেখালেখি গোল্লায় যাচ্ছে। আগে প্রায় প্রতিদিনই একটা করে গল্প লিখত, এখন মাস পেরিয়ে যায়, তাহসীনের ছোট্ট একটা গল্পও সমাপ্ত হয় না। জেসমিনই এখন তার পৃথিবী। ধীরে ধীরে আরও প্রকট হয় ব্যাপারটা। একসময় দেখা যায় তাহসীনের লেখার টেবিলে ধূলো জমতে শুরু করেছে। রাতভর কেউ আর বসে এখানে গল্প বুনে না। এভাবেই মৃত্যু ঘটে একজন গল্পকারের। নষ্ট হয় একটি দীপ্তিমান প্রতিভা।

সাইফ রাহমান ●  নির্বাহী সভাপতি, সৃজনঘর