কোটাপ্রথা বিলুপ্ত হোক

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ০৯ ২০১৮, ১৬:১৪

কোটাবিরোধী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ এই আন্দোলন সফল হলে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ভালোরকম ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এর সুফল সবাই ভোগ করবে; যারা চাকরিবাকরিতে আগ্রহী নয়, তারাও। কারণ স্রেফ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগদান করা হলে, দেশ সামগ্রিকভাবে মেধাবীদের সেবা পাবে। দেশের উপকার নাগরিকেরাই ভোগ করবে।

মূলত কোটা পদ্ধতির সংস্কার নয়, সৎকারই কাম্য। এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার এখনই মূলোৎপাটন করা জরুরি। আরো আগেই করা উচিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান কোটা, নারী কোটা আর উপজাতি কোটা তো নয়ই; প্রতিবন্ধী কোটাও কাম্য নয়। এসব কোটার মাধ্যমে মেধার অবমূল্যায়ন করা হয়, অযোগ্যদেরকে যোগ্যদের স্থানে বসানো হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান কোটা, নারী কোটা আর উপজাতি কোটার অপ্রয়োজনীয়তা তো স্বীকৃত। এমনকি প্রতিবন্ধী কোটাও যৌক্তিক নয়। শারীরিক প্রতিবন্ধী যদি মেধাবী হয়, তাহলে সে মেধাবী হিসেবে উপযুক্ত চাকরি পাওয়ার অধিকার রাখে। আর যদি তেমন মেধাবী না হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব ভিন্নভাবে নিতে হবে। প্রয়োজনে বিনা পরিশ্রমে ভাতা দিতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে তাদের পুনর্বাসন করা অসম্ভব নয়।

অমেধাবী বা তুলনামূলক কম মেধাবীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের জন্যও তাদের উপযোগী কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। কোটার জোরে তাদেরকে উপরে উঠিয়ে যোগ্যদের অধিকারহরণ ও রাষ্ট্রকে মেধাবী কর্মীর সেবা থেকে বঞ্চিত করা যেমন উচিত নয়, তেমনি কোটা থাকবে না বলে রাষ্ট্র তাদের ব্যাপারে দায়িত্বমুক্তও হয়ে যেতে পারে না। তাদের জন্যও তাদের উপযোগী যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সরকারেরই দায়িত্ব।

দুই.
আমি বিশ্বাস করি, এই আন্দোলন স্বার্থবুদ্ধি-তাড়িত আন্দোলন। কোটাপদ্ধতি দ্বারা যদি আন্দোলনকারীরা ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হতো, তাহলে এরা আন্দোলন করত না। নিজের পেটে পারা না পড়লে এখন কেউ আন্দোলন করে না। এই স্বার্থতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব শুধু এদের মধ্যে আছে, তা কিন্তু নয়। সবার মধ্যেই কমবেশ আছে। এখন ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে বাংলাদেশে কেউ আন্দোলন করে না। এজন্যই স্রেফ কলাম লেখার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অপসারিত হলেও ছাত্ররা আর সহশিক্ষকেরা প্রতিবাদ করে না। এই প্রতিবাদহীনতার সংস্কৃতি সবারই ক্ষতি করে। তবু কেউ খুব চিন্তিত হয় না। কারণ তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রভাব বোঝা যায় না; আরো বেশি ক্ষতিকর হলেও, তা হয় ধীর প্রক্রিয়ায়।

এই আন্দোলন ব্যক্তিস্বার্থ-তাড়িত আন্দোলন হলেও ন্যায় ভিত্তিক। ব্যক্তিগতভাবে অন্যায়ের শিকার হওয়াও অন্যায়ই। সুতরাং অন্যায়ের শিকার ব্যক্তি-সমষ্টির এই আন্দোলন সমর্থন করি। ছাত্রদের ন্যায় ভিত্তিক আন্দোলন যারা উপেক্ষা করছে, তারাও ব্যক্তি-স্বার্থতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব দ্বারা সংক্রমিত মনে করি।

তিন.
এই সরকারের সময় বিশেষ এক প্রকারের আন্দোলনের সংস্কৃতি চালু হয়েছে। সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েও আন্দোলনকারীরা সরকারের সমালোচনা করতে চায় না। যৌক্তিক আন্দোলন করার সময়ও তাদেরকে প্রমাণ করতে হয় যে, এরা সরকারবিরোধী লোক নয়। বরং আরো একধাপ এগিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, এরা সরকারের পক্ষেরই একটা পক্ষ। এরা সরকারকে দোষারোপ না করে কল্পিত ভুল বোঝানেঅলাদের ঘাড়ে দোষ চাপায়। সরকার কোনো ভুল পদক্ষেপ নিলে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ভাষা হয়— ‘সরকারকে ভুল বুঝিয়ে করা হয়েছে।’

সরকারবিরোধী হলে যৌক্তিক আন্দোলন কেন করা যাবে না, যৌক্তিক হলে কেনই বা তা মানা হবে না— যদিও তা আমাদের বোধগম্য নয়। যেভাবেই হোক, এই অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনও সেই ধারার আন্দোলন। আন্দোলনের চরিত্রের দিকে তাকালে এটাই প্রতিভাত হয়।

এই ধরনের আন্দোলনের কিছু উপকার তো আছেই। ক্ষতিকর দিক হলো— সরকারবিরোধী লোক হলে তার আন্দোলনের ন্যায্যতা থাকে না, এমন একটা মনোভাব প্রচ্ছন্ন থাকে। যা সামগ্রিকভাবে যথেষ্ট ভয়াবহ।

‘সরকারকে ভুল বুঝিয়ে’— এরকম কথা বলে যে কোনো আন্দালনই সরকারের জন্য ভালো। দেশে সরকারবিরোধিতার সুযোগ আছে, গণতন্ত্রান্ত্রিকতা জারি আছে; কিন্তু রিস্ক নাই। ঝুঁকিমুক্ত গণতান্ত্রিকতা চলতে দেওয়া সরকারের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। সরকার এসব আন্দোলন সাধারণত সর্বশক্তি দিয়ে দমন করে না। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলন ‘সরকারকে ভুল বুঝিয়ে’ ধরনের হলেও সরকার দমন করছে। কারণ এর সঙ্গে এতদিনের সুবিধাপ্রাপ্ত এলিট শ্রেণির স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত। সেই শ্রেণিটাকে হাতে রাখা সরকাররের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

-আবুল কাসেম আদিল
লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।