কেমন ছিল সর্বকালের শ্রেষ্ঠতর মানবের দৈনন্দিন রুটিন?

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ০৮ ২০১৯, ১৬:৫৩

-আরজু আহমাদ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জাগার পর সাহাবীদের সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করতেন। নামাজের স্থানে বসেই সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত আল্লাহর স্মরণ ও দোয়া করতে থাকতেন। (মুসলিম ৬৭০)

সাহাবিরাও তাঁর সঙ্গে অবস্থান করতেন। কখনো কখনো তারা জাহিলিয়াতের ঘটনা বলাবলি করে হাসাহাসি করতেন, রাসুলও তাদের কথায় মুচকি হাসতেন। নিজে রাতে স্বপ্ন দেখে থাকলে তা সাহাবিদের বলতেন কিম্বা কোনও সাহাবি নিজের স্বপ্ন বললে তিনি এর ব্যাখ্যা করতেন।

রাতে কোরআনের কোনও অংশ নাজিল হলে তাও শোনাতেন। সাহাবিদের কারো প্রশ্ন থাকলে এর উত্তর প্রদান শেষে ঘরে ফিরে যেতেন। ঘরে ফিরে চার রাকাত কিম্বা এরচে’ বেশি পরিমাণে দোহার সালাত আদায় করতেন। (মুসলিম ৭১৯)

তিনি নিজের ঘরকন্নার সব কাজেই শামিল হতেন। অন্য সব পুরুষেরা নিজের সংসারের জন্য যা করে তিনি এর সবই করতেন। এমনকি নিজের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজও নিজেই সম্পন্ন করতে কখনোই দ্বিধা করেন নি।

যেমন তিনি দুধ দোহাতেন, ছিঁড়ে যাওয়া জামায় তালি দিতেন, ছেঁড়া জুতো সেলাই করতেন। নিজের পরিধেয় জামা নিজেই কাঁচতেন। (আহমাদ ২৬১৯৪)

এরপর জোহরের নামাজের সময় এলে মসজিদের দিকে বেরুতেন৷ নামাজের শেষে সাহাবিদের সঙ্গে বসতেন, আলাপ করতেন, নসিহত করতেন। অভিযোগ শুনতেন, বিচারকার্য সম্পাদনা করতেন। পুনরায় ঘরে ফিরে যেতেন।

তিনি ছিলেন নবী এবং দায়ী৷ একইসঙ্গে ছিলেন দায়িত্ববান স্বামী, পিতা এবং নেতা। পরিবার প্রধান হিসেবে পরিবারের জন্য যা প্রয়োজন তিনি এর সবই আঞ্জাম দিতেন। ( বুখারী ৬৭৬)

খাবারের ব্যাপারে তাঁর অভ্যেস ছিল কোনও খাবারের দোষ ধরতেন না। ইচ্ছে হলে খেতেন। নতুবা রেখে দিতেন। এমনও সময় অতিবাহিত হয়েছে, যখন মাস পেরিয়ে গেছে অথচ ঘরে খাবার বলতে শুধু খেজুর আর পানি৷

একবার তো এই অবস্থা টানা তিন চন্দ্রমাস অবধি ছিল৷ তবুও অসন্তোষের, দুশ্চিন্তার সামান্যতম কিছুই তাঁরমধ্যে পরিলক্ষিত হয় নি কখনো। (বুখারী ৩৫৬৩, মুসলিম ২০৬৪)

সেকালে সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যাতেই আহার করা হতো। আমাদের মত তিনিবেলা খাওয়ার রীতি ছিল না। সকালে ও সব্ধ্যায় তিনি নবীয পান করতেন। সাধারণত দুপুরে অল্প সময়ের জন্য ঘুমোতেন। মানে ভাতঘুম আরকি। যেন রাতে অধিক ইবাদাত করতে পারেন। (আল-আওসাত, ২৮)

তিনি প্রায়শই বিকেলে লোকেদের দৈনন্দিন জীবনের খোঁজখবর নিতে বেরুতেন। বাজার পরিদর্শনে যেতেন। অসুস্থদের খোঁজখবর নিতে স্বশরীরে উপস্থিত হতেন। লোকেদের দাওয়াত থাকলে কবুল করতেন। (বায়হাক্বী ২০৮৫১, মুসলিম, ১০২)

তাঁর দিনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত হয়েছে লোকেদের দ্বীনের দিকে আহ্বান করে। মানুষের অধিকারের পক্ষে কাজ করে, প্রয়োজন সম্পন্ন করে। ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের মধ্য দিয়ে।

তিনি কথা বলতেন অল্প, আল্লাহর জিকির করতেন বেশি। নামাজ দীর্ঘায়িত করতেন। অসহায় ও দূর্বলের কোনও প্রয়োজন পূরণ করার চেয়ে অধিক তৃপ্ত হতে তাঁকে আর কিছুতেই দেখা যায় নি। (নাসাঈ, ১৪১৪)

ঈশার নামাজের পর মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনও বিষয় থাকলে প্রবীণ, প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞ সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। নতুবা পরিবারকে কিছুটা সময় দিতেন। (তিরনিযী, ১৬৯; আহমাদ ১৭৮)

রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল মেজাজের মানুষ। লোকেদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল কোমলতর। তিনি খরচের ব্যাপারে ছিলেন মুক্তহস্ত।

যে স্ত্রীর কামরায় রাত যাপন করবেন, ইশার পর সেখানে তাঁর বাকি স্ত্রীগণও জড়ো হতেন। রাসুল তাঁদের সঙ্গে খুনসুটি করতেন, আড্ডা হত। কখনো কখনো একত্রে সন্ধ্যার নাশতা করতেন। এরপর আম্মাজানদের প্রত্যেকে তাঁর স্ব স্ব কামরায় ফিরে যেতেন।

তিনি এক চাদরের নিচেই স্বস্ত্রীক রাত্রীযাপন করতেন। শোবার সময় সাধারণত উপরের জামা খুলে নিতেন। লুঙ্গি পরিধান করে ঘুমোতেন। (তাফসিরে ইবনে কাসীর, ২/২৪২)

রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে জাগ্রত হতেন। মিসওয়াক, ওযু শেষে রাতের বাকি অংশ ইবাদাত করতেন। বিলাল রা. আজান দিলে আরও দুই রাকাত সালাত আদায় শেষে মসজিদে যেতেন। (আবু দাউদ ৫৬, বুখারী ৪৫৬৯, মুসলিম ৭৬৩)

তাঁর অভ্যেস ছিল তিনি ছোটবড়ো সকলকেই সালাম দিতেন। লোকেদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। তিনি ছিলেন বিনয়ের সর্বোচ্চ স্তরে। ধৈর্যের মূর্ত প্রতিক। ক্ষমার উজ্জ্বলতর দৃষ্টান্ত। এমন কখনো হয় নি যে, কেউ কখনো তাঁর কাছে কোনও সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।

মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা এই পবিত্র চরিত্রের চারিত্রিক সনদ দিয়ে কোরআনে বলছেন, وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ

“এবং নিশ্চয় আপনি সু-মহান চরিত্রের অধিকারী।” (৬৮ঃ৪)

আমাদের যাপিত জীবন পরিচালিত হোক সেই আদর্শে। প্রতিটি কাজ হোক সেই মরু-পুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে৷ শান্তির জন্য এর বাইরে আদতে আমাদের জন্য আর কোনও পথ নেই। আমাদের আইকন, আমাদের আইডল হচ্ছেন আমাদের নবী। তাঁর জীবনী হচ্ছে আমাদের শ্রেষ্ঠ স্কুল। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।