কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস ও পাঠদান পদ্ধতি;যুগ চাহিদার অনুধাবন জরুরি 

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ১২ ২০২১, ০৭:০৬

মোঃ আব্দুল হাসিব:

ইসলামের শিক্ষাকে মৌলিকভাবে ৫ ভাগে বিভক্ত করা হয়।

১.ঈমান

২.ইবাদাত

৩.আখলাক (আচার-আচরণ,চরিত্র)

৪.মুআমালাত (আর্থিক লেনদেন)

৫.মুআশারাত (ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ এর সাথে সহাবস্থান)।

কওমি মাদ্রাসাগুলোতে কুরআন-হাদিস এর আলোকে এই পাঁচটি বিষয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়। এই শিক্ষা একজন মানুষকে মানুষ হতে শেখায়।উচ্চমাত্রার নৈতিকতা ও মানবতার শিক্ষা দেওয়া হয় এই প্রতিষ্ঠানে।

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার ধরন,শিক্ষা সিলেবাস এবং এগুলোর কার্যকারিতা প্রমাণিত। যেই উদ্দেশে এই মাদ্রাসা শিক্ষার প্রবর্তন তা বাস্তবায়নে এই প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সফল বলা যায়। পুরো পৃথিবী আজকে এর ফলাফল দেখতে পাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার এই ধারাকে আরও কার্যকরী করতে এর নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যুগ চাহিদা অনুধাবন করে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে এর শিক্ষার্থীদের দ্বারা জাতি আরো বেশি উপকৃত হতে পারবে।

প্রথমেই আসি সিলেবাসের কথায়। অনেকেই কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসে পরিবর্তনের কথা বলেন। আমি মনে করি,পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। কিছু সংযোজন ও বিয়োজন দরকার। যদিও আমাদের মুরব্বিগণ এই ছোট্ট বাস্তবতা মেনে নিতেও অনিচ্ছুক।

১.যখন ফার্সী ভাষার প্রয়োজন ছিলো তখন আমাদের আকাবির খুব গুরুত্ব দিয়ে এই ভাষা শিখিয়েছেন। যদিও তা আমাদের কুরআন-সুন্নাহর ভাষা না। অথচ এখন ইংরেজি ভাষার ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও এটাকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে শিখানো হয় না। এই দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

২.সংক্ষেপণ এবং সহজিকরণ এর নামে অযথাই যুক্তিবিদ্যা,দর্শন,আরবি ভাষার অলংকার শাস্ত্রকে সীমিত করা হয়েছে। অথচ এ শাস্ত্রগুলো মেধাকে তীক্ষ্ম করে। বুদ্ধির জোর বাড়ায়। দর্শন ছাড়া কোনো শিক্ষার গভীরে পৌঁছানো যায় না। এক্ষেত্রে করণীয় হল, পুরাতন ও আধুনিক যুক্তি বিদ্যা ও দর্শনকে সমন্বয় করে আরো ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া।

৩.শর্ট কোর্স নামীয় নতুন এক শিক্ষা পদ্ধতির আবির্ভাব। আমরা কেন কুরআন সুন্নাহর এই বহুমাত্রিক,গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকে এতো সস্তা বানিয়ে ফেলার চেষ্টা করছি। এর পেছনে কি উদ্দেশ্য কাজ করে আল্লাহই ভালো জানেন। এই অর্ধ শিক্ষায় শিক্ষিত করে কি লাভ হচ্ছে। এর দ্বারা শিক্ষাক্ষেত্রে পঙ্গুত্ব আসে। যারা কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে অল্প কিছু জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাদেরকে দ্বীনিয়াত সম্পর্কে কিছু শিক্ষা দিলেই হয়। দাওরায়ে হাদিস ফারেগ হতে হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা শরিয়তে নেই। শায়খুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রাহিমাহুল্লাহ আসামের মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য যে সিলেবাস প্রণয়ন করেছিলেন তা ছিলো ১৬ বছর মেয়াদি। এই বিষয়টি ভাবনায় নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।

৪.”ইতিহাস” শিক্ষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।অথচ ইতিহাসের বড় একটা অংশের কোনো ধারণাই মাদ্রাসা শিক্ষাথী’দের নেই। হযরত মাদানি রহ. এর প্রণীত সিলেবাসে উল্লেখ ছিলো কুরআন,সুন্নাহ এবং ফিকহের পর সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে ইতিহাস।

৫.ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিষয় এর মধ্যে ঈমান এবং ইবাদতের শিক্ষা যেই গুরুত্বের সঙ্গে দেওয়া হয়। ঠিক ততটুকু অবহেলা করা হয় বাকি তিন বিষয়ের ক্ষেত্রে। অথচ বাকি তিনটি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সমাজবিজ্ঞান,রাষ্ট্রবিজ্ঞান,অর্থনীতি,ব্যবসা বাণিজ্যর মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্টগুলো।

আমাদের মুরব্বিগণ কি কখনো ভেবেছেন এসব বিষয় নিয়ে? কখনো কি চিন্তা করেছেন,এভাবে کمیت তথা কোয়ানটিটি বা পরিমাণ না বাড়িয়ে کیفیت তথা কোয়ালিটি বা গুনগত মানের দিকে নজর দেওয়া উচিত। তারা কি ভেবেছেন আমাদের ছেলেরা যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হচ্ছে কিনা? যেভাবে সক্ষম ছিলেন আমাদের আকাবির ও আসলাফ।

শুধু ওয়াযের মাঠে ”চিল্লায়া কন ঠিক কিনা” বলতে পারার মধ্যেই কি যোগ্যতা সীমাবদ্ধ থাকবে?আমাদের ছেলেরা কি যুগের হযরত কাসেম নানুতবি,হযরত রশিদ আহমদ গাংগুহি হতে পারছে?এ বিষয়গুলো নিয়ে কবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে? আর কত কাল এই অধপতন চলতে থাকলে আমাদের বধোদয় ঘটবে?

এবার আসি মেয়েদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায়।এখানে মৌলিক সমস্যা তিনটি। প্রাথমিকভাবে এই মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

১.মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য সুচিন্তিত কোন নেসাব নেই। আমাদের সমাজের মেয়েদের নৈতিক উন্নয়ন,মানসিক বিকাশ,পারিবারিক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা এবং প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগরণের নিমিত্তে মেয়েদের যথোপযুক্ত ও বিশেষায়িত কোন শিক্ষা সিলেবাস প্রণয়ন করা হয় নাই। হ-য-ব-র-ল মার্কা যেই সিলেবাসের আলোকে তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয় তা জাতির প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ। এইজন্যই হযরত আয়েশা সিদ্দিকার রাযি.এর মত জ্ঞানী,মহীয়সী নারীর যোগ্য উত্তরসূরি পাওয়ার আশা করাও কঠিন।

২.মাদ্রাসার মেয়েদের পাঠদান পদ্ধতি বহু আগ থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। এরপরও তা পরিবর্তনের লক্ষণ নাই। এই পদ্ধতি অনেক ফেতনার জন্ম দেয়।অতএব নিরাপদ এবং কার্যকরী পাঠদান পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

৩.মেয়েদের আবাসিক শিক্ষা ব্যবস্থা বহু ফেতনার দ্বার উন্মোচনকারী একটি পদ্ধতি। দারুলউলুম দেওবন্দে পড়াকালীন এক দরসে আমাদের ওস্তাদ মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানী দা.বা.বলেছিলেন,সকাল থেকে নিয়ে বিকাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মেয়েদের মাদ্রাসা শিক্ষার সময় নির্ধারণ করতে হবে। মেয়েদেরকে কোন অবস্থাতেই রাতেরবেলা আবাসিক রেখে শিক্ষা পদ্ধতির ব্যবস্থা করা সমীচীন না। অথচ আমরা কি করছি!

পরিবর্তন অপরিহার্য। অন্যথায় অধঃপতন কেউ ঠেকাতে পারবেনা।

যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুগ চাহিদা অনুধাবন করে পথ চলতে হবে।

লেখক: আলেম, গবেষক ও সাহিত্যিক