উমরী কাযা-একটি দালিলিক পর্যালোচনা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ফেব্রুয়ারি ০৩ ২০২০, ২১:১২

♦মুফতী আবদুল মালিক রফিকী♦

নামায নির্ধারিত ওয়াক্তের মধ্যে না পড়ে পরবর্তী সময়ে পড়লে তা হয় কাজা নামায। কোরআন হাদীসের যেমনিভাবে যথাসময়ে নামাজ আদায়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি সময়মতো আদায় না হলে তা কাযা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যুগ যুগ ধরে মুহাদ্দিসগণ এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। মাসআলাটি এত প্রসিদ্ধ যে সাধারণ মুসলমান সমাজও এসম্পর্কে অবগত।

কিন্তু ইদানিং এনিয়ে নতুন বিভ্রান্তির শুরু হয়েছে। কেউ কেউ প্রচার শুরু করেছে নতুন নতুন মত। ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দিলে তার কাযা নেই। এমন বক্তব্য প্রচার হয়েছে কোনো কোনো গণমাধ্যমেও। সঙ্গত কারণেই বিভ্রান্ত হচ্ছে মুসলিম সমাজ এবং এ নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসা আসছে ফতুয়া বিভাগগুলোতে। বক্ষমাণ নিবন্ধে এ বিষয়ে দালিলিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সকলের বোধগম্য করার স্বার্থে এর শিরোনাম দেয়া হয়েছে উমরী কাযা।

তাওহীদ রেসালাত ও আখিরাতের আলোচনার পর কুরআনে কারীমে অসংখ্য স্থানে সুস্পষ্টভাবে নামাযের কথা উল্লেখ করেছেন। এবং তার বান্দাকে নামাযের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন।অপরদিকে নামায পরিত্যাগকারীর ও নামাজে অবহেলাকারী কে মর্মান্তিক শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। বস্তুত শরীয়তে ঈমানের পরেই নামাজের স্থান এবং ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।

এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

رأس الأمر الإسلام، وعموده الصلاة،وذروة سنامه الجهاد. رواه الترمذي في سننه، ২/৮৯

وقال هذا حديث حسن صحيح.

সবকিছুর মূল ইসলাম আর নামায হলো এর খুটি জিহাদের উচ্চতা।

অতএব যে ব্যক্তি নামায কায়েম করল প্রকৃতপক্ষে সে দ্বীন কায়েম করল। আর যে ব্যক্তি নামায নষ্ট করল সে দ্বীন বিনষ্ট করল।বহু হাদিসে ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ পরিত্যাগ করাকে কুফরি কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

অতএব, এ কাজে লিপ্ত থাকলে (আল্লাহ না করুন) কোন একসময় পুরোপুরি ঈমানহারা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

بين الرجل بين الشرك والكفر ترك الصلاة

নামায ত্যাগ করা হলে শিরকের সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের সূচনা হয়।( সহীহ মুসলিম হাদিস ৮২ , জামে তিরমিজি ২/৯০,)

অন্য হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী আবুদ্দারদা রা. কে বলেন,

ولا تترك صلاة مكتوبة متعمدا،فمن تركها متعمدا فقد برئت منه الذمة. رواه ابن ماجه،قال البوصيري في مصباح الزجاجة،

اسناده حسن.

তুমি ফরজ নামায ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করবে না। কেননা, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তা পরিত্যাগ করে তার ওপর থেকে আল্লাহ তাআলার দায়িত্ব উঠে যায়। (সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস ৩০১.)

হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু তার গভর্নদের নিকট ফরমান লিখে পাঠান যে,

إن أهم أمركم عندي الصلاة،فمن حفظها أو حافظ عليها،حفظ دينه ، ومن ضيعها فهو لما سواها اضيع …

নিঃসন্দেহে তোমাদের সকল কর্মের মধ্যে নামাযই আমার নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি এর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করল, সে নিজের দ্বীনকে রক্ষা করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার নষ্ট করবে সে ওপর বিষয়াবলীকে আরো অধিক বিনষ্ট করবে।

এরপর তিনি নামাযের সময়ের বিবরণ উল্লেখ করেন।

মুয়াত্তা ইমাম মালেক ৩ উপরোক্ত হাদিস সমূহ থেকে শরীয়তে নামাযের মান অবস্থান সুস্পষ্ট ভাবে বুঝা যায় এবং নামাজের ব্যাপারে অবহেলা করা যে কত বড় অপরাধ এবং এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা উপরোক্ত হাদিস সমূহ থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়।

নামাযের সময় নির্ধারিত।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

إن الصلاة كانت على المؤمنين كتابا موقوتا

নিঃসন্দেহে মুমিনদের প্রতি নামায অপরিহার্য রয়েছে, যা সময়সীমা নির্ধারিত।

সূরা নিসা আয়াত ১০৩

পবিত্র কোরআনে নামাযের সময়সীমা নির্ধারিত হওয়ার বিষয়টি যেমন উল্লেখিত হয়েছে, তেমনি নির্ধারিত সময়ে তা অনাদায়ী থেকে গেলে পরবর্তী সময়ে তা কাযা করার বিষয়টিও উল্লেখিত হয়েছে।

সহিহ হাদিস ও আসারে সাহাবাএ বিষয়টির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা বিদ্যমান রয়েছে।

আদা ও কাযার বিবরণ।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি নামায আদায় করা হয় তবে তাকে আদা বলা হয় এবং পরে আদায় করা হলে তাকে কাযা বলা হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই এক হাদীসে ইবাদতের কাযার দর্শনটি হৃদয়গ্রাহী করে বুঝিয়েছেন।

প্রিয় পাঠক, আরেকটি আমাদের সকলেরই জানা আছে যে, একে অন্যের প্রতি যে হক রয়েছে তা দুই প্রকার,

১/আল্লাহর হক্ব

২/বান্দার হক্ব

আল্লাহর হক তথা: নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি।

নামায যেহেতু আল্লাহর হক্ব প্রমাণিত হলো, এবার আসুন, আল্লাহর হক সময়মতো আদায় না করতে পারলে পরবর্তীতে আদায় করতে হবে কি না, এবিষয়ে হাদীসের আলোকে জানবো।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, এক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, আমার মা মান্নত করেছিলেন যে, তিনি হজ্জ করবেন। কিন্তু তা পূর্ণ করার আগেই তিনি মারা গেছেন। (এখন আমার করনীয় কি?)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন,

حجي عنها، أرايت لو كان على أمك دين اكنت قاضيته؟ ،قالت نعم. فقال اقضوا الله الذي له ، فان الله أحق بالوفاء.

তুমি তার পক্ষ থেকে হজ্জ করো।বলতো, যদি তোমার মা কারো নিকটে ঋনী হতেন তুমি কি তার ঋণ পরিশোধ করতে? মহিলাটি বলল, হাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বললেন, তবে তোমরা আল্লাহর ঋণও পরিশোধ করো। কেননা তিনি তার প্রাপ্য পাওয়ার অধিক উপযুক্ত।

সহি বুখারী, ১/২৪৯-২৫০

সুনানে নাসায়ী, ২/২

অপর এক বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল হে আল্লাহর রাসূল আমার পিতা মারা গেছেন, কিন্তু তিনি হতে পারেননি। আমি কি তার পক্ষ থেকে করতে পারি‌ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু বললেন,

أرايت لو كان على أبيك دين، أكنت تقضيه؟ قال نعم: فدين الله أحق.

বলতো, তোমার পিতা যদি কারো নিকট ঋণী হতেন তবে কি তুমি তার ঋণ পরিশোধ করতে? লোকটি বলল, হাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর অধিক আদায়যোগ্য।

সুনানে নাসাঈ ২/৩

উপরোক্ত বর্ণনা সমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, فأقضوا الله

তোমরা আল্লাহর ঋণ পরিশোধ কর।

فدين الله أحق

আল্লাহর ঋণ আদায়ের অধিক উপযুক্ত।

এসব থেকে সুস্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে, যে ইবাদতটি বান্দার উপর ফরয বা অবশ্য কর্তব্য। তা থেকে দায়মুক্তির পথ হল তা আদায় করা। দায়মুক্তির জন্য এছাড়া ভিন্ন কোন পন্থা শরীয়তে নেই। যেমন নির্ধারিত সময় পার হওয়ার ফলে যেমন মানুষের ঋণ থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় না, তেমনি আল্লাহর ঋণ থেকেও দায়মুক্ত হওয়া যায়না।

শরীয়তের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাযের ব্যাপারে এই মূলনীতি প্রযোজ্য হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও আমল এবং সাহাবায়ে কেরামের আশা এই প্রমাণ বহন করে।

মুলনীতি প্রযোজ্য হওয়া সম্পর্কে কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি।

১.প্রসিদ্ধ সকল হাদিস গ্রন্থের বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, সে ঐতিহাসিক ঘটনা।

একরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবাগণ কে নিয়ে সফর করেছিলেন।শেষ রাতের তারা বিশ্রাম এর উদ্দেশ্যে যাত্রা বিরতি করলেন।হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কে ফজরের নামাযের জন্য জাগিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে বেলাল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু তন্দ্রাভিভূত হয়ে গেলেন, ফলে ফজরের নামাজ কাজা হয়ে গেল।পরে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম সবাইকে নিয়ে ফজর নামাজ আদায় করলেন।

হাদীস ও ফিকহের কিতাবে এই রাতটি ليلة التعريس এবং এই ঘটনাটি واقعة التعريس নামে পরিচিত।

এ হাদীসের অন্যতম আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এই ঘটনাটি উল্লেখ করে বলেন, সেই দুই রাকাত নামাজ আমার নিকটে সমগ্র দুনিয়ার মালিকানা লাভ করার চেয়েও অধিক পছন্দনীয়।

মুসনাদে আহমদ ২৩৪৯।

হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু খুশি হওয়ার কারণ কি?

উত্তর হলো, এই ঘটনার মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর সহচরবৃন্দ যারা আগামী দিনে শরীয়তের বিধি-বিধান পৌঁছানোর গুরু দায়িত্ব পালন করবেন,তাদের সামনে এই মূলনীতি সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, নামায নির্ধারিত সময় আদায়যোগ্য হলেও যদি তা সময়মতো আদায় না করা হয়, তবে সময়ের পরে হলেও তা আদায় করা অপরিহার্য।

আল ইসতিযকার, ১/৩০০

 

২/খন্দকের যুদ্ধে শত্রুবাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের কয়েক ওয়াক্ত নামায কাযা হয়ে যায়, তারা রাতের বেলায় তা আদায় করে নেন।

সহিহ বুখারি ১/৮৩-৮৪

৩/ খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফেরার দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের কে বললেন,

لا يصلين أحد العصر إلا في بنى قريضة

তোমাদের কেউ বনী কুরায়জায় না পৌঁছে আসর নামাজ পড়বে না।

(সহিহ বুখারী হাদীস ৯৪৬ )

সাহাবায়ে কেরাম রওয়ানা হলেন, আসরের নামায অতিবাহিত হওয়ার উপক্রম হলে কতক সাহাবী পথেই নামায পড়ে নেন‌। আর কতক সাহাবী বনী কুরায়যায় পৌঁছে সময়ের পরে আসরের নামায কাযা পড়েন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এই ঘটনা শুনেছেন, কিন্তু পরে কাযা আদায় কারী সাহাবাদেরকে একথা বলেননি যে, নামায শুধু নির্ধারিত সময় আদায়যোগ্য, সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে এর কোন কাযা নেই। এসব দৃষ্টান্তের বিপরীতে কোন একটি হাদীস বা আসারে সাহাবীতেও একথা উল্লেখিত হয়নি যে, নির্ধারিত সময়ে নামায পড়া না হলে তা আর কাযা পড়তে হবে না। এক্ষেত্রে অপরাধ মোচনের জন্য যথেষ্ট। একথা কোথাও নেই।

এরপরেও কিছু অবুঝ ভাইয়েরা এব্যাপারে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।

 

এছাড়া আরো কয়েকটি হাদিস রয়েছে,

১. عن انس بن مالك قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم. إذا رقد أحدكم عن الصلاة أو غفل عنها فاليصلها إذا ذكرها. فإن الله يقول أقم

الصلاة لذكري.

 

হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম ইরশাদ করেছেন যখন তোমাদের কেউ নামায ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়ে নামায থেকে গাফেল হয়ে যায় তাহলে তার যখন হয় তখন সে যেন তা আদায় করে নেই কেননা আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন আমাকে স্মরণ হলে নামায আদায় করো।

(সহিহ মুসলিম ১৬০১)

২.

عن انس بن مالك قال سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم. علن الرجل يرقد عن الصلاة او يغفل عنها قال كفارتها يصليها إذا ذكرها.

হযরত আনাস ইবনে মালেক থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে নামাজে যাবো নামায সম্পর্কে গাফিল ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন এরা হলো যখনই নামাযের কথা স্মরণ হবে তখনই তা আদায় করে নিবে।

(সহীহ ইবনে খুযাইমা ৯৯১-

সুনানে নাসায়ী ১৫৮৫)

৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট দিয়ে গমন কালে বললেন তোমরা কি জানো তোমাদের পালনকর্তা কি বলেন সাহাবীগণ বললেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবারও জানেন এভাবে তিনবার প্রশ্ন-উত্তরের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা বলেন

وعزتي و جلالي لا يصليها عبد لوقتها إلا أدخلته الجنة. ومن صلاها لغير وقتها، إن شئت رحمته وإن شئت عذبته.

আমার মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের কসম, যে ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে নামায আদায় করবে আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো, আর যে ব্যক্তি নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর তা আদায় করবে আমি তাকে অনুগ্রহ করতে পারি আযাবও দিতে পারি।

(আল মুজামুল কাবীর, ১০/২২৮. হাদীস, ১০৫৫৫)

হাদীসটি হাসান।

সহিহ মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ফক্বীহ ইমাম নববীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস

من نسي صلاة فاليصلها إذا ذكرها

এহাদীসটির উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন।

فيه وجوب قضاء الفريضه الفائته. سواء تركها بعذر كنوم ونسيان ام بغير عذر. وانما قيد في الحديث بالنسيان لخروجه على سبب ازا وجاب القضاء على المعذور بالوجوب. وهو من باب التنبيه بالأدني على الاعلى.

এই হাদিসে ছুটে যাওয়া ফরজ নামাজ সমূহ আদায়ের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়।

নামাজটি কোন ওজর বশত যথা: ঘুম, ভুলে যাওয়া ইত্যাদি কোন ওজরে কাযা হোক কিংবা বিনা ওজরে কাযা হোক।

হাদিস শরিফে শুধু ভুলে যাওয়ার কথা এজন্যই উল্লেখিত হয়েছে, কেননা, ওজর বশত,যার নামায কাজা হয়েছে তার জন্যও যদি আদায় করা অপরিহার্য হয়, তাহলে অন্যদের জন্য অপরিহার্য হবে তা তো বলা বাহুল্য। এটি যেন ছোট বিষয়ে সতর্ক করে বড় বিষয় গুরুত্ব বাড়িয়ে দেওয়ার অংশ।

শরহে মুসলিম ৫/১৮৩.

যেমন কুরআনুল কারীমের মধ্যে সূরা বনী ইসরাঈল ২৩ নম্বর আয়াতের একটি অংশ,

فلا تقل لهما أف

তোমাদের পিতা মাতাদেরকে উফ্ শব্দ বলোনা।

এর মানে এই নয় যে, তাদেরকে প্রহার করতে পারবে, বা ভিন্ন কোন কষ্ট দিতে পারবে।

যাইহোক, এই পর্যন্ত আমরা কোরআন ও সুন্নাহের আলোকে আলোচনার মাধ্যমে এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে, কাজা নামায পড়তে হবে, এছাড়া অন্য কোন পন্থা শরীয়তে বিদ্যমান নেই।

এবার আসুন আমরা প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ফিকহ ও ফাতাওয়ার আলোকে দেখবো কাজা নামায সম্পর্কে ইমামগণ কি বলেছেন।

 

* হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা ইবনে নুজাইম রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

فالأصل فيه أن كل صلاة فاتت عن الوقت بعد ثبوت وجوبها فيه. فإه يلزم قضاؤها. سواء تركها عمدا أو سهوا أو بسبب نوم. وسواء كانت الفوائت قليلة أو كثيرة

 

যে নামায নির্ধারিত সময়ে আদায় হয়নি,তার কাযা আদায় করা অপরিহার্য। ইচ্ছা কৃতভাবে নামায পরিত্যাগ করা হোক বা ভুলক্রমে বা ঘুমন্ত অবস্থায় কাযা হোক, কাযা নামাজের সংখ্যা বেশি হোক বা কম হোক।

আল বাহরুর রায়েক, ২/১৪০-৪১.

 

* মালেকী মাযহাবের ইমাম ইমাম মালেক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

من نسي صلوات كثيرة أو ترك صلوات كثيرة فاليصل على قدر طاقته. فاليذهب إلى حوائجه فإذا فرغ من حوائجه صلى أيضا ما بقي عليه حتى يأتي على جميع ما نسي أو ترك.

 

যে ব্যক্তির অনেক নামায ভুলক্রমে কাযা হয়ে গেল,সে প্রয়োজনাদী সম্পন্ন করার মাঝে মাঝে তা কাযা করতে থাকবে এবং তার কামাকৃত সকল নামায আদায় করবে।

আল-মদাওয়ানাতুল কুবরা, ১/১২৩

* শাফেয়ী মাযহাবের ফিকহের যে সকল কিতাব রয়েছে এর অন্যতম কিতাব, ফাতহুল জাওয়াদে উল্লেখিত হয়েছে,

(من فاتته … مكتوبة) فاكثر قضى ما فاتته بعذر أو غيره. غير المعذور يلزمه القضاء فورا. ويظهر أنه يلزمه صرف جميع زمنه للقضاء ما عدا ما يحتاج لصرفه فيما لا بد منه.

যে ব্যক্তির এক বা একাধিক ওয়াক্ত নামায কাযা হয়েছে, ওজর বশত হোক বা বিনা ওজরে কাযা হোক। তার জন্য সকল নামাজের কাযা আদায় করা অপরিহার্য। তবে বিনা ওজরে নামায পরিত্যাগ কারীকে অনতিবিলম্বে কাযাকৃত সকল নামায আদায় করতে হবে। এবং অতি প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ছাড়া পূর্ণ সময় ঐ কাজে ব্যয় করতে হবে।

ফাতহুল জাওয়াদ, ১/২২৩.

 

* হাম্বলী মাযহাবের অতি নির্ভরযোগ্য ইমাম আল্লামা মারদাভী রহ. বলেন।

من فاتته صلوات لزمه قضاؤها على الفور. هذا المذهب نص عليه. وعليه جماهير الأصحاب وقطع به كثير منهم.

যে ব্যক্তির অনেক নামায কাযা হয়েছে তার জন্য অনতিবিলম্বে তা আদায় করা অপরিহার্য।

আল ইনসাফ, ১/ ৪৪২-৪৪৩.

প্রিয় পাঠক, চার মাযহাবের নির্ভরযোগ্য ইমামদের মতামত আমরা জানলাম।কিন্তু একথা আমরা কোথাও পাইনি এবং কেউ একথা বলেনি যে, কাজা নামাজ পড়তে হবে না।

কাজা নামাজের জন্য শুধু তওবা-ইস্তেগফার করলেই অপরাধ মোচনের জন্য যথেষ্ট হবে।

কোথাও একথা নেই।

প্রত্যেকই দৃঢ়তার সাথে একথা বলেছেন যে, কাজা নামাজ যাদের হয়েছে, তারা অবশ্যই তা আদায় করতে হবে। এ ছাড়া ভিন্ন কোনো পন্থা শরীয়তে নেই।

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ, ফকিহগনের এই মতামত গুলো উল্লেখ করে তাদের সাথে একমত পোষণ করেছেন।

তিনি স্পষ্ট ভাবে বলেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা ওজরবশত হোক, ফরজ নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় না করা হলে পরে তা আদায় করা অপরিহার্য।

মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া, ২৩/২০৯

 

এবং কাজা নামাজ সুন্নাত সহ আদায় করতে হবে কি না এ সম্পর্কে তিনি বলেন,

المسارعة إلى قضاء الفوائت الكثيرة أولى من الإشتغال بالنوافل. وأما مع قلة الفوائت فقضاء السنن معها حسن.

যদি কাজা নামাজের পরিমাণ অনেক বেশি হয়, তবে সুন্নত নামাজে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে ফরজ নামাজ আদায় করাই উত্তম। আর যদি কাজা নামাজের পরিমাণ কম হয়, তবে ফরজের সাথে সুন্নাত আদায় করলে এটি উত্তম কাজ হবে।

মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া, ২২/১০৪

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে কথা গুলো ভালভাবে বুঝার তৌফিক দান করুন এবং সর্বক্ষেত্রে যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে আকড়ে ধরে দৈনন্দিন জীবনযাপন করতে পারি।

আল্লাহ সকলকে তৌফিক দান করুন। আমিন।