ইয়াযীদ রহমতুল্লাহ নাকি লা’নতুল্লাহ: কেন এই সীমালঙ্ঘন?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ১১ ২০১৯, ১৯:৪০

হুসাইন আহমদ বাহুবলী

তাফসীর, হাদীস, আকীদাহ এবং ইতিহাসের কিতাবগুলো অধ্যয়ন করে যতদূর জানতে পেরেছি, তাতে দেখা যায় সালফে সালেহীনের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং অনুকরণীয় কোন ইমামের কিতাবে ইয়াজিদের উপর লানত করা বৈধ হওয়ার কথা আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কেউ তার নামের শেষে রাহিমাহুল্লাহ বা লা’নাহুল্লাহ এ দু’টি বাক্যের কোনটিই উল্লেখ করেন নি। সুতরাং তিনি যেহেতু তার আমল নিয়ে চলে গেছেন, তাই তার ব্যাপারে আমাদের জবান দরাজ করা ঠিক নয়।

তাকে গালাগালি করাতে আমাদের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু অর্জিত হবে না। তার আমল নিয়ে তিনি চলে গেছেন। আমাদের আমলের হিসাব আমাদেরকেই দিতে হবে। তার ভাল মন্দ আমলের হিসাব তিনিই দিবেন।

ইমাম যাহাবী ইয়াযীদের ব্যাপারে বলেন:
ﻻﻧﺴﺒﻪ ﻭﻻﻧﺤﺒﻪ
অর্থাৎ “আমরা তাকে গালিও দিবো না এবং ভালও বাসবো না।” মদ পান করা, বানর নিয়ে খেলা করা, ফাহেশা কাজ করা এবং আরও যে সমস্ত পাপ কাজের অপবাদ ইয়াজিদের প্রতি দেয়া হয়, তা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। তবে তার চেয়ে হুসাইন রা. যে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সুতরাং তিনি মুসলিম ছিলেন। তার জীবনের শেষ মুহূর্তে আমরা যেহেতু উপস্থিত ছিলাম না, তাই তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াই অধিক নিরাপদ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমার উম্মতের একটি দল কুস্তুনতীনিয়ায় যুদ্ধ করবে। তাদেরকে ক্ষমা করা দেয়া হবে।

ইসলামের ইতিহাস বলে ইয়াজিদ বিন মুআবিয়া ছিলেন সেই যুদ্ধের সেনাপতি। আর হুসাইন রা. তাতে সাধারণ সৈনিক হিসেবে শরীক ছিলেন। সুতরাং ইয়াজিদ যদি ক্ষমায় শামিল হতে পারে এতে আমাদের ক্ষতি কি ? তাই ইয়াযীদের সমালোচনায় সীমালঙ্ঘন করলে সীমালঙ্ঘনকারীও আল্লাহর আদালতে আসামি কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

আমাদের কোন কোন আকাবির কারবালার ইতিহাস চর্চাতে অনীহা প্রকাশ করতেন। তারা বলতেন,
یہ وہ خون ہے جس سے اللہ تعالی نے ہمارے ہاتھوں کو محفوظ کر دیا اب ہمارے لئے لازم ہے ہم اس خون سے ہمارے زبان کو محفوظ رکھے
যে রক্তের ছোঁয়া থেকে আল্লাহ আমাদের হাতকে রক্ষা করেছেন, সেই রক্তে যেন আমরা আমাদের মুখ রঙ্গিন না করি।

আমরা ইয়াযীদ বিষয়ে সীমালঙ্ঘন কেন করছি? এর কয়েকটি কারণ আছে-

১. বিষাদসিন্ধুর কাল্পনিক ও মিথ্যা কাহিনী:
বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ মীর মোশাররফ হুসাইন কর্তৃক রচিত বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসটি পড়ে থাকেন। কারবালায় ইমাম হুসাইন রা. নিহত হওয়ার ঘটনাকে বিষয়বস্তু করে এই উপন্যাসটি লিখিত হয়েছে। এতে ইমাম হুসাইনের ফযীলতে অসংখ্য বানোয়াট কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে।

অপর পক্ষে ইয়াযীদকে এমন এমন অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার সঠিক কোন দলীল খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বইটি বাংলাভাষী মুসলিমগণ বিশেষ গুরুত্বের সাথে পাঠ করে থাকেন।

পরিতাপের বিষয় হল, আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোর সিলেবাসের বাংলা সাহিত্য বইয়েও প্রবন্ধ আকারে বিষাদ সিন্ধু থেকে নির্বাচন করে বেশ কিছু অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

এসব পড়ে ও শুনে মুসলিম ছাত্রগণ কারবালার ঘটনা সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে গড়ে উঠছে। দাখিল শ্রেণীতে এক সময় বাংলা সাহিত্য বইয়ে ‘হায়রে অর্থ!’ নামে একটি প্রবন্ধ ছিল। এই প্রবন্ধে ইয়াযীদকে যে সমস্ত দোষে দোষারোপ করা হয়েছে, তা পাঠ করে বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। কারণ এগুলোকে এমনভাবে সাজিয়েগুছিয়ে সাহিত্য মান দিয়ে লেখা হয়েছে, তা খুবই আকর্ষণীয়। সুতরাং এটি কারবালার ব্যাপারে সুন্নী মুসলিমদের ভিতরে ভুল ধারণা প্রবেশের অন্যতম কারণ।

২. সরকারী কর্মসূচী ও তৎপরতা:
মুহাররাম ও আশুরা উপলক্ষে আমাদের দেশের সকল সরকারই তার নিয়ন্ত্রিত রেডিও, টেলিভিশন এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে বিশেষ কর্মসূচী ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে থাকে।
এই দিন সরকারী ছুটি থাকে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেতা-নের্তৃদের বাণীও প্রচার করা হয় এই মাধ্যমগুলোতে। ইয়াযীদের প্রতি দোষারোপ ও ইমাম হুসাইনের প্রশংসাই থাকে এগুলোর মূল বিষয়। প্রত্যেক দল নিজেদেরকে হোসাইনী সৈনিক এবং প্রতিপক্ষকে ইয়াযীদী বাহিনী হিসেবে উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

এ কথা ঠিক যে, যারা হুসাইন রা.কে হত্যা করেছে তারা স্বৈরাচারী, জালেম ও পৈশাচিক নরপশু, বরং পশুর চেয়েও অধম ছিল। তাই বলে যুগ যুগ ধরে বিষয়টি নিয়ে নির্বিচারে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়।

আরও উল্লেখ করা হয় যে, কারবালায় মুহাররাম মাসের ১০ তারিখে স্বৈরাচারী ও পৈশাচিক নরপশুর হাতে রাসূলের পবিত্র দৌহিত্র ইমাম হুসাইনের শাহাদতকে কেন্দ্র করেই এদিনটি মুসলিম উম্মাহর নিকট একটি পবিত্র দিন হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

সুতরাং তাদের ভাষায় এটি একটি ধর্মীয় পবিত্র দিন। তারা এ কথাটি একবারের জন্যও উচ্চারণ করে না যে, আশুরার দিনটি ইসলামের বহু যুগ আগে থেকেই ফযীলতপূর্ণ ও পবিত্র। আল্লাহর নবী মুসা আ. এই দিনে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ রোজা রেখেছেন। পরবর্তীতে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এর উপর জোর দিয়েছেন। তাছাড়া মুহাররমের ১০ তারিখে আল্লাহ তাআলা আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটিয়েছেন, সে সম্পর্কে এরা কোন ইঙ্গিতই করে না।

তারা এটি জানে না যে, ইমাম হুসাইন রা. শহীদ হয়েছেন, ৬১ হিজরীর মুহাররাম মাসের ১০ তারিখে।
আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন ১১ হিজরী সালে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর সাথে সাথে অহী আসার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই অহীর দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ৫০ বছর পর যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তাকে কেন্দ্র করে কোন অনুষ্ঠান ইসলামের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে না।

যেদিন সেই ঘটনা ঘটেছে সেই দিনও পবিত্র হতে পারে না। কুরআন ও সহীহ হাদীস যে সমস্ত স্থান ও সময়কে পবিত্র বলে ঘোষণা করেছে, তা ব্যতীত কোন দিন ও সময় পবিত্র হতে পারে না।

৩.শিয়াদের প্রচারণা:
আমাদের দেশে শিয়াদের সংখ্যা একেবারে কম হলেও ইসলামের লেবাস পড়ে তারা আশুরার দিন তাজিয়া মিছিল, মার্সিয়া এবং আরও অনেক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।
তারা প্রতি বছর এই দিনে ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে হুসাইন রা.’র প্রতীকি লাশ বহন করে শোক মিছিল করে, শরীরে ছুরি দিয়ে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করে।

শরীরে রক্তের মত লাল রং লাগিয়ে হায় হুসাইন হায় হুসাইন করে চিৎকার করে এবং বুক ও গালে চপেটাঘাত করে। হুসাইন রা.’র প্রতি তাদের এই আবেগ ও কল্পিত ভালবাসা দেখে সরল মনা ও নবী পরিবারের প্রেমিক সুন্নী মুসলিমগণ প্রভাবিত হয়ে তাদের বর্ণনা বিশ্বাস করে থাকেন।

যার কারণে আমাদের দেশের সুন্নী মুসলিমগণ শিয়াদের প্রতিবাদে কোন কথা শুনতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। আসলে এটি যে, মাছের মায়ের পুত্র শোকের মত তা বুঝার মত পর্যাপ্ত দ্বীনি জ্ঞান ও সঠিক ইতিহাস তাদের জানা নেই।

সুতরাং বাড়াবাড়ি সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগানদাতা এই সকল উপসর্গ পরিহার করে, সকল প্রকার প্রান্তিকতার ত্যাগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মধ্যপন্থাই হচ্ছে ইসলাম।