ইসলামে মাতা-পিতার অধিকার ও আজকের প্রেক্ষাপট

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ১১ ২০২০, ২২:৫৯

মুফতি আহমদ যাকারিয়া
সন্তানের কাছে মাতা-পিতার প্রাপ্য অধিকারই তাদের হক। সৃষ্টি জগতে মানুষের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ প্রদর্শনকারী ব্যক্তি হচ্ছেন মাতা-পিতা। তাই মাতা-পিতাই তার সর্বাপেক্ষা আপনজন। মাতা-পিতার প্রতিই সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য সর্বাধিক। সন্তানের জন্য অবধারিত মাতা-পিতার প্রতি অবশ্য পালনীয় এসব দায়িত্ব কর্তব্যই মাতা-পিতার হক রূপে আখ্যায়িত হয়।
এই পৃথিবীতে মাতা-পিতা সন্তানের সবচেয়ে আপনজন। যাদের মাধ্যেমে সন্তান এই পৃথিবীর আলো দেখতে পারে। তাই আল্লাহর বিধান মতে তাদের প্রতি সদাচারণ করা সন্তানের জন্য অত্যাবশ্যক।
মাতা-পিতার খেদমত সন্তানের উপর প্রয়োজন এবং সামর্থ্যানুযায়ী ফরজ আবার কখনো তা ওয়াজিব।
মাতা-পিতার খেদমত করার সুযোগ পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। মে’রাজের রজনীতে যে ১৪টি বিষয় স্থির হয়েছিল, তার মধ্য হতে
প্রথমটি হলো: আল্লাহর হক তাওহিদ বা একত্ববাদ এবং শিরক তথা অংশীবাদ করা থেকে মুক্তি।
দ্বিতীয়টি হলো: পিতা-মাতার হক বা অধিকার এবং সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং করণীয় ও পালনীয় সম্পর্কে।
মাতা-পিতার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনের জন্য কুরআনে আল্লাহ পাক  সন্তানদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, সন্তানের কারণে মাতা-পিতার কষ্ট হয় এবং তাদের মুখ থেকে যাতে ‘উহ্’ শব্দটি বের না হয়, এমনভাবে তাদের সেবা যত্ন করতে হবে। কুরআন এবং হাদিসে মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালন নিয়ে বহুভাবে তাকিদ দেয়া হয়েছে। তবে শেষ যুগে এসে অনেক সন্তানকেই পিতা-মাতার প্রতি উদাসীন হতে দেখা যায়। তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। যে পিতা-মাতা নিজে কষ্ট করে বা না খেয়ে সন্তানকে অত্যন্ত মায়া-মমতা দিয়ে যত্ন করে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলেন; দেখা যায় যে, সেই পিতা-মাতা সন্তানের দ্বারা অনেক সময় অবহেলিত, বঞ্চিত ও কষ্টের সম্মুখীন হন। মাঝে মধ্যে  এমন সংবাদও দেখা যায় যে, বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সুশিক্ষিত অনেক সন্তান রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায়। অনেকে তাদের বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। যে পিতা-মাতা গায়ের রক্ত পানি করে সন্তানের ভরণ-পোষণ করে বড় করে তোলে, বৃদ্ধ বয়সে সেই পিতা-মাতাকেই অত্যন্ত কষ্টের সাথে দিন যাপন করতে হয়। সাধারণত পারিবারিক মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতাকে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হতে হয়।
সুসন্তান এবং দায়িত্বশীল পিতা-মাতা একে অপরের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে, এটাই মানব সভ্যতার মূল শিক্ষা। একে অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল না হলে মানুষের জন্য প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সন্তান জন্মদানের পর পিতা-মাতা যেভাবে নিজের জীবন তুচ্ছ করে সন্তানকে আগলে রাখে, তাকে বড় করে তোলে তার মূল্য কোনো কিছুর বিনিময়ে হয় না। পিতা-মাতার মূল্য সন্তানের পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। অথচ দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, বর্তমানে পরিবার ও সমাজে যে নৈতিক মূল্যবোধের অভাব এবং অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, তাতে পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক অনেকটা শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অনেক পিতা-মাতার ব্যস্ততার কারণে সন্তানের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে না পারায় সন্তান যেমন বিপথে চলে যাচ্ছে, তেমনি পিতা-মাতা নিজের জীবনের দিকে না তাকিয়ে সন্তানকে মানুষ করার জন্য যেভাবে নিবেদিত, তা অনেক সন্তান উপলব্ধি করছে না। ফলে অনেক উচ্চশিক্ষিত সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতা উপেক্ষিত হচ্ছে। তারা পিতা-মাতাকে বোঝা মনে করছে। তারা পিতা-মাতার সাথে এক সাথে বসবাস করার চিন্তা না করে আলাদা করে দিচ্ছে কিংবা কোন বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ঠিক মতো ভরণ-পোষণ দিচ্ছে না। এক সাথে থাকলেও বাবা-মায়ের যথাযথ খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। তারা এটা বুঝতে চায় না যে, এক সময় তাদেরও বৃদ্ধকালে উপনীত হতে হবে এবং তাদের সন্তানরাও অনুরূপ আচরণ তাদের সাথে করতে পারে। যদি একবার চিন্তা করে, তাদের মানুষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পিতা-মাতা কতোটা ত্যাগ ও সংগ্রাম করেছেন এবং কুরআন ও হাদিসে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টি স্মরণ করে, তবে কোন সু-সন্তানের পক্ষে পিতা-মাতার প্রতি উদাসীন থাকার কথা নয়। পরিতাপের বিষয়, আধুনিক যুগে এসে সন্তানদের মধ্যে এ ধরনের বোধ ও উপলব্ধি খুব কমই কাজ করতে দেখা যায়। তারা এটা মনে করে না, যে পিতা-মাতা নিজেদের নিঃশেষ করে তাদের গড়ে তুলেছে, বৃদ্ধ বয়সে এসে তারা কোথায় যাবে, কার কাছে থাকবে, কে দেখা-শোনা করবে। অনেকের মধ্যে এ প্রবণতা কাজ করে, পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারলেই ভালো। ফলে অসংখ্য পিতা-মাতা বৃদ্ধ বয়সে এসে সন্তান কর্তৃক উপেক্ষিত ও অবহেলার শিকার হচ্ছে। এ কারণেই সরকার পিতা-মাতার ভরণ- পোষণের বিষয়টি সন্তান কর্তৃক নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। অথচ এটা আইনের বিষয় নয়, এটা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের স্বাভাবিক দায়িত্ব এবং মায়া-মমতার বিষয়।
মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব:
পৃথিবীতে হাজারও সম্পর্কের মাঝে সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্কের বন্ধন গড়ে ওঠে সন্তান এবং মাতা-পিতার মধ্যে। যারা আমাদেরকে এই পৃথিবীতে এনে এর অফুরন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দিল তারা আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবা-মা। খুব অসহায় অবস্থায় একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। পৃথিবীতে এসে পিতা-মাতার যথাযথ লালন-পালন, আদর, স্নেহ, মমতা ও শিক্ষা-দীক্ষার মাঝে বেড়ে উঠে সন্তান। সুতরাং সন্তানের জীবনে পিতা-মাতার অবদান অনস্বীকার্য। পিতা-মাতার এই অবদান পরিমাপ করা বা এর মূল্য নির্ণয় করা কোনো সন্তানের পক্ষেই পুরোপুরিভাবে সম্ভব নয়। সন্তানের জন্য পিতা-মাতা একমাত্র নিরাপদ স্থান। সুতরাং প্রত্যেক সন্তানের উচিত মাতা-পিতার প্রতি তাদের যে কর্তব্য তা সঠিকভাবে পালন করা এবং সব সময় তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা।
সদাচারের ক্ষেত্রে মাতা-পিতার স্থান হলো সকল মানুষের ঊর্ধ্বে। কেননা, মানব জন্মের মূল হলো মাতা-পিতা। সন্তানের নিকট তাদের চেয়ে বড় আপনজন পৃথিবীতে অন্য কেউ নেই। তাঁরাই হলেন সন্তানের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ ও দয়া প্রদর্শনকারী। তাঁদেরকে সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা, ভক্তি করা, প্রত্যেকটি সন্তানের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। শুধু তাই নয়; বরং এগুলো তাঁদের হক বা অধিকার।
প্রশ্ন হতে পারে যে, হক আবার কী? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, কোন মানুষের নিকট কারো ন্যায্য পাওনা বা অধিকারকেই হক বলা হয়। সুতরাং সন্তানের নিকট মাতা-পিতার ন্যায্য পাওনাকেই মাতা-পিতার হক বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীতে আল্লাহর পরে মাতা-পিতাই হলেন সন্তানের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহশীল। কেননা, তাঁরা উভয়েই তাঁদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে সন্তানদের লালন-পালন করে থাকেন। এমনকি সন্তানের সুখ-শান্তির জন্য তাঁরা হাসিমুখে সব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে থাকেন।
তবে উভয়ের মধ্যে তুলনামূলকভাবে সন্তানের জন্য সর্বাধিক দুঃখ-কষ্ট, যাতনা, ব্যথা ও আঘাত সহ্য করতে হয় মায়ের। গর্ভাবস্থায় মা সীমাহীন কষ্ট ও যাতনা ভোগ করে থাকেন। এমনকি কখনও বমি, কখনও ক্ষুধামন্দা, কখনও উদরে ব্যথা, জ্বর, হাত-পায়ে শোথ পরিলক্ষিত হয়। এরূপ শারীরিক অবস্থা দেখে মা অনেক সময় হতাশ হয়ে যান যে, তিনি বোধ হয় আর বাঁচবেন না।অবশেষে সন্তানের জন্ম বা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় মায়ের কী পরিমাণ কষ্ট হয় যার হিসাব কোন দার্শনিক, কোন বৈজ্ঞানিক, কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নির্ধারণ করতে পারেননি এবং পারবেনও না।
সন্তানের জন্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হচ্ছে তার মাতা-পিতা। এ কারণে সন্তানের জীবনে মাতা-পিতার গুরুত্বও সবচেয়ে বেশি। তাদের অধিকার প্রদান করাই সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সন্তানদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে সব থেকে প্রথমে যেটা আসে তা হলো পিতা-মাতার সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। বাবা-মায়ের সন্তুষ্টি অনুযায়ী সন্তানের পথ চলা উচিত। প্রত্যেক সন্তানের উচিত সব সময় পিতা-মাতার বাধ্য থাকা এবং তাদের আদেশ নিষেধ মেনে চলা। বাবা-মায়ের যখন বার্ধক্য চলে আসে তখন তারা নবজাতক শিশুর মতোই অসহায় হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে বোঝা না ভেবে তাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা সন্তানের দায়িত্ব। এবং এতেই সন্তানের কল্যাণ নিহিত।
শরীয়াহ’র আলোকে মাতা-পিতার হক:
পিতা মাতার হক সর্বমোট ১৪ টি। জীবিত অবস্থায় ৭ টি হক রয়েছে:
১. আজমত অর্থাৎ পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
২. মনে প্রাণে মুহাব্বত করা।
৩. সর্বদা তাঁদেরকে মেনে চলা।
৪. তাঁদের খেদমত করা।
৫. তাঁদের জরুরত (প্রয়োজন) পুরা করা।
৬. তাঁদেরকে সর্বদা আরাম পৌঁছানোর ফিকির (চিন্তা ভাবনা) করা।
৭. নিয়মিত তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ ও দেখাশুনা করা।
মৃত্যুর পর ৭ টি হক রয়েছে:
১. তাঁদের মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করা।
২. সওয়াব রেছানী করা।
৩. তাঁদের সাথী-সঙ্গী ও আত্মীয়-স্বজনদের সম্মান করা।
৪. সাথী-সঙ্গী ও আত্মীয়-স্বজনের সাহায্য করা।
৫. ঋন পরিশোধ ও আমানত আদায় করা।
৬. শরী‘আতসম্মত ওসিয়ত পুরা করা।
৭. মাঝে মাঝে তাদের কবর যিয়ারত করা।
শরীয়াহ’র আলোকে মাতা-পিতার হক:
কুরআনে আল্লাহ পাক তাঁর নিজের অধিকারের পরেই পিতা-মাতার অধিকারের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَآ أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًا وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا رَّبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا فِي نُفُوسِكُمْ إِن تَكُونُواْ صَالِحِينَ فَإِنَّهُ كَانَ لِلأَوَّابِينَ غَفُورًا
‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারু উপাসনা করো না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তুমি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ করো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। তুমি তাদের সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলো’। ‘আর তাদের প্রতি মমতাবশে নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাঁদের প্রতি দয়া কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবে দয়াপরবশে লালন-পালন করেছিলেন’। ‘তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের অন্তরে যা আছে তা ভালো ভাবেই জানেন। যদি তোমরা সৎকর্ম পরায়ণ হও, তবে তিনি তাওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল’।
(বনী ইসরাঈল: ২৩-২৫)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ স্বীয় ইবাদাতের সঙ্গে পিতা-মাতার সেবাকে একত্রিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এর মাধ্যমে এটিকে তাওহীদের বিশ্বাসের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বুঝানো হয়েছে। এর কারণ সৃষ্টিকর্তা হিসেবে যেমন আল্লাহর কোনো শরীক নেই, জন্মদাতা হিসেবে তেমনি পিতা-মাতারও কোন শরীক নেই। আল্লাহর ইবাদত যেমন বান্দার উপর অপরিহার্য, পিতা-মাতার সেবাও তেমনি সন্তানের উপর অপরিহার্য।
যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে,
أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ
‘অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রেখ, তোমার) প্রত্যাবর্তন আমার কাছেই’। (লোকমান: ৩১/১৪)
এখানেও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতাকে সমানভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
উপরোক্ত আয়াতে
وَقَضَى رَبُّكَ
‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন’। এই আদেশ অর্থ ‘চূড়ান্ত ফায়সালা’। কেননা আল্লাহর ইবাদতের ফায়সালা যেমন চূড়ান্ত, পিতা-মাতার সেবা করার ফায়সালাও তেমনিভাবে চূড়ান্ত। এই সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন বা নড়চড় নেই। যেমন অন্যত্র এসেছে,
قُضِيَ الْأَمْرُ الَّذِي فِيهِ تَسْتَفْتِيَانِ
‘তোমরা যে বিষয়ে জানতে আগ্রহী, তার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে’। (ইউসুফ ১২/৪১)
পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ কেন করতে হবে?
আল্লাহ বলেন,
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ-
‘(আল্লাহ বলেন,) আর আমরা মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছেন এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রেখ, তোমার) প্রত্যাবর্তনস্থল আমার কাছেই’।
(লোকমান: ৩১/১৪)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلاَثُونَ شَهْرًا-
‘আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার জন্য। তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছেন কষ্টের সাথে এবং প্রসব করেছেন কষ্টের সাথে। তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধ পান ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস’ (আহক্বাফ: ৪৬/১৫)
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, গর্ভ ধারণের সর্বনিম্ন মেয়াদ ছয় মাস। (কুরতুবী)
কেননা বাচ্চাকে দু’বছর যাবৎ বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে মায়েদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন,
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ-
‘জন্মদানকারিনী মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে, যদি তারা দুধপানের মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়’। (বাক্বারাহ: ২/২৩৩)
মানুষ তার পিতা-মাতার মাধ্যমেই দুনিয়াতে এসেছে। অতএব তারাই সর্বাধিক সদাচরণ পাওয়ার যোগ্য।
আল্লাহ বলেন,
هَلْ أَتَى عَلَى الْإِنْسَانِ حِينٌ مِنَ الدَّهْرِ لَمْ يَكُنْ شَيْئًا مَذْكُورًا- إِنَّا خَلَقْنَا   الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا-
‘নিশ্চয়ই মানুষের উপর যুগের এমন একটি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না’। ‘আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি (পিতা-মাতার) মিশ্রিত শুক্রবিন্দু হতে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। অতঃপর আমরা তাকে করেছি শ্রবণশক্তি সম্পন্ন ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন’।
(দাহর:৭৬/১-২)
মাতা-পিতার শরীয়াত বিরোধী কথা ব্যতীত সব মানতে হবে:
আল্লাহ বলেন,
 وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا
‘আর যদি পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয় আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করার জন্য, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পার্থিব জীবনে তাদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলবে’। (লোকমান:৩১/১৫)
এখানে শিরক বলতে আল্লাহর সত্তার সঙ্গে অন্য কিছুকে শরীক করা। একইভাবে আল্লাহর বিধানের সঙ্গে অন্যের বিধানকে শরীক করা বুঝায়। ধর্মের নামে ও রাষ্ট্রের নামে মানুষের মনগড়া সব বিধান এর মধ্যে শামিল। অতএব, পিতা-মাতা যদি সন্তানকে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বাইরে অন্য কিছু করতে চাপ দেন, তবে সেটি মানতে সন্তান বাধ্য নয়। কিন্তু অন্য সব বিষয়ে সদাচরণ করবে।
মুছ‘আব বিন সা‘দ তার পিতা সা‘দ বিন খাওলা হতে বর্ণনা করেন যে, আমার মা একদিন আমাকে কসম দিয়ে বলেন, আল্লাহ কি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দেননি?
فَوَاللهِ لاَ أَطْعَمُ طَعَاماً وَلاَ أَشْرَبُ شَرَاباً حَتَّى أَمُوتَ أَوْ تَكْفُرَ بِمُحَمَّدٍ
‘অতএব, আল্লাহর কসম! আমি কিছুই খাবো না ও পান করবো না, যতক্ষণ না মৃত্যুবরণ করব অথবা তুমি মুহাম্মাদের সঙ্গে কুফরী করবে’। (মুসনাদে আহমাদ:/১৬১৪)
ফলে যখন তারা তাকে খাওয়াতেন, তখন গালের মধ্যে লাঠি ভরে ফাঁক করে তরল খাদ্য দিতেন। এভাবে তিন দিন পর যখন মায়ের মৃত্যুর উপক্রম হলো, তখন সূরা আনকাবূত ৮ নাম্বার  আয়াত নাজিল হলো,
 وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلاَ تُطِعْهُمَا إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ-
‘আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যেন তারা পিতা-মাতার সঙ্গে (কথায় ও কাজে) উত্তম ব্যবহার করে। তবে যদি তারা তোমাকে এমন কিছুর সঙ্গে শরীক করার জন্য চাপ দেয়, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে তুমি তাদের কথা মান্য করো না। আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর আমি তোমাদের জানিয়ে দেব যেসব কাজ তোমরা করতে।’ (আনকাবূত:২৯/৮)
(মুসলিম হা/১৭৪৮; আহমাদ হা/১৫৬৭, ১৬১৪;)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, মা বললেন, তুমি অবশ্যই তোমার দ্বীন ছাড়বে। নইলে আমি খাব না ও পান করব না, এভাবেই মরে যাব। তখন তোমাকে লোকেরা তিরষ্কার করে বলবে,
يَا قَاتِلَ أُمِّهِ
 ‘হে মায়ের হত্যাকারী’! আমি বললাম,
 يَا أُمَّاهُ! لَوْ كَانَتْ لَكِ مِائَةُ نَفْسٍ، فَخَرَجَتْ نَفْسًا نَفْسًا مَا تَرَكْتُ دِينِي هَذَا فَإِنْ شِئْتِ فَكُلِي، وَإِنْ شِئْتِ فَلَا تَأْكُلِي
 ‘হে মা! যদি তোমার একশ’টি জীবন হয়, আর এক একটি করে এভাবে বের হয়, তবুও আমি আমার এই দ্বীন ছাড়ব না। এখন তুমি চাইলে খাও, চাইলে না খাও! অতঃপর আমার এই দৃঢ় অবস্থান দেখে তিনি খেলেন। তখন অত্র আয়াত নাজিল হলো। সা‘দ রা. বলেন, আমার কারণে এভাবে মোট ৪টি আয়াত নাজিল হয়েছে। (তিরমিযী: ৩১৮৯,)
বস্তত: এমন ঘটনা সব যুগে ঘটতে পারে। তখন মুমিনকে অবশ্যই দুনিয়ার বদলে দ্বীনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মুশরিক পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ:
আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মুশরিক মা আমার কাছে এসেছে। আমি কি তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সদ্ব্যবহার কর’। (বুখারী: ৩১৮৩; মুসলিম: ১০০৩) ইবনু হাজার আসকালানী রহ. বলেন, ঘটনাটি ছিল হুদায়বিয়া সন্ধি থেকে মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়কার। যখন তিনি তার মুশরিক স্বামী হারেছ বিন মুদরিক আল-মাখযূমীর সঙ্গে ছিলেন। (ফাতহুল বারী)
আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমার মা ছিলেন মুশরিক। একদিন আমি তার নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি আমাকে রাসূল সা. সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলেন, যা আমার নিকট খুবই অপছন্দনীয় ছিল। তখন আমি রাসূল সা. এর নিকট গিয়ে কাঁদতে লাগলাম এবং তার হেদায়াতের জন্য দোয়া করতে বললাম। অতঃপর তিনি দোয়া করলেন। এরপর আমি বাড়িতে ফিরে এসে দরজা নাড়লে ভেতর থেকে মা বলেন, তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। তারপর তিনি গোসল সেরে পোষাক পরে দরজা খুলে দেন এবং কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে তার ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। (মুসলিম: ২৪৯১; মিশকাত: ৫৮৯৫)
পিতা-মাতার সেবা জিহাদে যাওয়ার চেয়ে উত্তম:
আব্দুল্লাহ বিন আমর রাঃ বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাঃ এর দরবারে এসে বলল, আমি আপনার নিকটে হিজরত ও জিহাদের উপরে বায়আত করতে চাই। যার দ্বারা আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের কল্যাণ কামনা করি। রাসূলুল্লাহ সাঃ তাকে বললেন, তোমার পিতা-মাতার কেউ জীবিত আছেন কি? লোকটি বললো, হ্যাঁ। বরং দু’জনেই বেঁচে আছেন। আমি তাদের উভয়কে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। রাসূল সাঃ বললেন, এরপরেও তুমি আল্লাহর নিকট পুরস্কার আশা কর? লোকটি বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন,
فَارْجِعْ إِلَى وَالِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا فَفِيهِمَا فَجَاهِدْ ‘
তুমি তোমার পিতা-মাতার নিকট ফিরে যাও ও সর্বোত্তম সাহচর্য দান কর এবং তাদের কাছেই জিহাদ কর’।(মুসলিম: ২৫৪৯)
তিনি আরও বলেন,
فَارْجِعْ إِلَيْهِمَا فَأَضْحِكْهُمَا كَمَا أَبْكَيْتَهُمَا، وَأَبَى أَنْ يُبَايِعَهُ ‘
তুমি তাদেরকে হাসাও, যেমন তুমি তাদেরকে কাঁদিয়েছ। অতঃপর তিনি তার বায়আত নিতে অস্বীকার করলেন’। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, পিতা-মাতার সেবা কখনো কখনো জিহাদের চেয়ে উত্তম হয়ে থাকে। জমহুর আলেমগণের নিকটে সন্তানের উপর জিহাদে যাওয়া হারাম হবে, যদি তাদের মুসলিম পিতা-মাতা উভয়ে কিংবা কোন একজন জিহাদে যেতে নিষেধ করেন। কেননা তাদের সেবা করা সন্তানের জন্য ‘ফরযে আঈন’। পক্ষান্তরে জিহাদ করা তার জন্য ‘ফরযে কিফায়াহ’। যা সে না করলেও অন্য কেউ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের আমীরের হুকুমে।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাঃ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাঃ-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট কোন আমল সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, ওয়াক্ত মোতাবেক নামাজ আদায় করা। আমি বললাম, তারপর কি? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সেবা করা। বললাম, তারপর কি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, আউয়াল ওয়াক্তে নামাজ আদায় করা’।
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, পিতা-মাতার সেবা করার স্থান জিহাদে গমন করার উপরে।
মাতা-পিতার অবাধ্যতা শিরকের পরে মহাপাপ:
আবু বাকরাহ রাঃ হতে বর্ণিত রাসূল সাঃ এরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ কোনটি সে বিষয়ে খবর দিব না? আল্লাহর সাথে শিরক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। এসময় তিনি ঠেস দিয়ে ছিলেন। অতঃপর উঠে বসে বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্য। কথাটি তিনি বলতেই থাকলেন। আমরা ভাবছিলাম, তিনি আর থামবেন না’।
এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, শিরকের পরেই মহাপাপ হলো পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। এরপরে মহাপাপ হলো মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।
পিতা-মাতার পায়ের নিচে জান্নাত:
জাহেমাহ আস-সুলামী রাঃ বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাঃ এর নিকটে এলাম জিহাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পরামর্শ করার জন্যে। তিনি আমাকে বললেন, তোমার কি পিতা-মাতা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন,
الْزَمْهُمَا فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ أَرْجُلِهِمَا
‘তুমি তাদের নিকটে থাক। কেননা জান্নাত রয়েছে তাদের পায়ের নীচে’।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাহেমাহ আস-সুলামী রাসূলুল্লাহ সাঃ এর ডান দিক থেকে ও বাম দিক থেকে দু’বার এসে বলেন, আমি আপনার সাথে জিহাদে যেতে চাই এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের কল্যাণ কামনা করি। জবাবে রাসূল সাঃ বলেন, তোমার মা কি বেঁচে আছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূল সাঃ বললেন,   ارْجِعْ فَبَرَّهَا
‘ফিরে যাও। তার সাথে সদাচরণ কর’। অবশেষে তৃতীয়বার সম্মুখ থেকে এসে একই আবেদন করেন। তখন রাসূল সাঃ তাকে জিজ্ঞেস করেন তোমার মা কি জীবিত আছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূল সাঃ বললেন,
وَيْحَكَ الْزَمْ رِجْلَهَا فَثَمَّ الْجَنَّةُ
 ‘তোমার ধ্বংস হৌক! তার পায়ের কাছে থাক। সেখানেই জান্নাত’।
(ইবনু মাজাহ: ২৭৮১)
পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি:
আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর রাঃ হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন,
رِضَى الرَّبِّ فِى رِضَى الْوَالِدِ وَسَخَطُ الرَّبِّ فِى سَخَطِ الْوَالِدِ
‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি’।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাঃ বলেন, আমার স্ত্রীকে আমি ভালবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা তাকে অপসন্দ করতেন।  তিনি তাকে তালাক দিতে বলেন। আমি তাতে অস্বীকার করি। তখন বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাঃ-কে বলা হলে তিনি বলেন,
أَطِعْ أَبَاكَ وَطَلِّقْهَا، فَطَلَّقْتُهَا
‘তুমি তোমার পিতার আনুগত্য কর এবং তাকে তালাক দাও। অতঃপর আমি তাকে তালাক দিলাম’।
ঈমানদার ও দূরদর্শী পিতার আদেশ মান্য করা ঈমানদার সন্তানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু পুত্র ও তার স্ত্রী উভয়ে ধার্মিক ও আনুগত্যশীল হলে ফাসেক পিতা-মাতার নির্দেশ এক্ষেত্রে মানা যাবে না।
মায়ের সেবার গুরুত্ব:
আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার সেবা পাওয়ার সর্বাধিক হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা। অতঃপর তোমার রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়গণ যে যত নিকটবর্তী’।
অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তুমি তোমার মায়ের সেবা কর।
فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ رِجْلَيْهَا
‘কেননা জান্নাত তার দু’পায়ের নীচে’। (নাসাঈ: ৩১০৪)
পিতা-মাতার মৃত্যুর পর কর্তব্য:
প্রথম করণীয় হলো যে, তাঁদের ঋণ পরিশোধ করা ও অসিয়ত পূর্ণ করা। অতঃপর মীরাস বণ্টন করা।
(নিসা: ৪-১১)
অতঃপর পিতা-মাতার জন্য দো‘আ করা, সাদাক্বা করা এবং ইলম বিতরণ করা। আরেকটি হলো যে, তাদের পক্ষ হতে হজ্জ করা। তবে এজন্য উত্তরাধিকারীকে প্রথমে নিজের ফরয হজ্জ আদায় করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ জান্নাতে সৎকর্মশীল বান্দার মর্যাদার স্তর উঁচু করবেন। তখন সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে এটা আমার জন্য হল? তিনি বলবেন,
 بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ
‘তোমার জন্য তোমার সন্তানের ক্ষমা প্রার্থনার কারণে’। এজন্য সন্তানকে সর্বদা দোআ করতে হবে।
رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيرا
‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া কর যেমন তারা আমাকে শৈশবে দয়াপরবশ হয়ে লালন-পালন করেছিলেন’। (ইসরা: ১৭-২৪)।
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ-
‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং ঈমানদার সকলকে ক্ষমা কর; যেদিন হিসাব দন্ডায়মান হবে’। (ইবরাহীম:১৪-৪১)
সাদাক্বার মধ্যে ঐ সাদাক্বা উত্তম, যা সাদাক্বায়ে জারিয়াহ, যা সর্বদা জারি থাকে ও স্থায়ী নেকী দান করে। এর মধ্যে সর্বোত্তম হল ইলম বিতরণ করা। যে ইলম মানুষকে তাওহীদ ও সুন্নাহর পথ দেখায় এবং শিরক ও বিদআত হতে বিরত রাখে। উক্ত উদ্দেশ্যে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান  খাতে সহযোগিতা প্রদান করা, সেজন্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পরিচালনা করা ইত্যাদি।
অতঃপর মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা নির্মাণ ও পরিচালনা, রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণ, অনাবাদী জমিকে আবাদ করা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, দাতব্য চিকিৎসালয় ও হাসপাতাল স্থাপন ও পরিচালনা করা ইত্যাদি।
জানা আবশ্যক যে, সাদাক্বায়ে জারিয়াহ দু’ভাবে হতে পারে।
১-মৃত ব্যক্তি স্বীয় জীবদ্দশায় এটা করে যাবেন। এটি নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম। কারণ মানুষ সেটাই পায়, যার জন্য সে চেষ্টা করে।
(নাজম ৫৩/৩৯)
২- মৃত্যুর পরে তার জন্য তার উত্তরাধিকারীগণ বা অন্যেরা যেটা করেন।
আরেকটি বিষয় মনে রাখা আবশ্যক যে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সাদাক্বায়ে জারিয়াহ’র ধরন পরিবর্তন হয়ে থাকে। অতএব যেখানে বা যাকে এটা দেওয়া হবে, তার গুরুত্ব ও স্থায়ী কল্যাণ বুঝে এটা দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে সদা সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যে, যেন উক্ত সাদাক্বা ধর্মের নামে কোন শিরক ও বিদ‘আতের পুষ্টি সাধনে ব্যয়িত না হয়। যা স্থায়ী নেকীর বদলে স্থায়ী গোনাহের কারণ হবে।
পিতা-মাতা না থাকলে খালা-ফুফুর সঙ্গে সদ্ব্যবহার:
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাঃ বলেন, জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি বড় পাপ করেছি। আমার কি কোন তাওবা আছে? রাসূলুল্লাহ সাঃ তাকে বললেন, তোমার কি পিতা-মাতা আছে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তোমার কি খালা আছে? সে বলল, আছে। তিনি বললেন, তাহলে তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর’।
বারা বিন আযেব রাঃ হতে বর্ণিত রাসূল সাঃ বলেন,
الْخَالَةُ بِمَنْزِلَةِ الأُمِّ
‘খালা হলেন মায়ের স্থলাভিষিক্ত’।
একইভাবে চাচা ও মামু সমান মর্যাদার অধিকারী।
রাসূলুল্লাহ সাঃ স্বীয় চাচা আবু ত্বালিবের নিকটে লালিত-পালিত হয়েছিলেন এবং হিজরতের পর মদীনায় স্বীয় দাদার মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
খালা মায়ের দিক দিয়ে এবং ফুফু পিতার দিক দিয়ে সন্তানের সর্বাধিক নিকটবর্তী। রাসূলুল্লাহ সাঃ পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের পরেই বলেছেন,
 ثُمَّ أَدْنَاكَ أَدْنَاكَ
‘অতঃপর যে তোমার সর্বাধিক নিকটবর্তী তার সাথে সদ্ব্যবহার কর’। (মিশকাত: ৪৯১১)
রাসূলুল্লাহ সাঃ সাফা পাহাড়ে উঠে যেদিন কুরায়েশগণকে তাওহীদের আহবান জানান, সেদিন নিজ কন্যা ফাতেমার পরেই
يَا صَفِيَّةُ عَمَّةَ رَسُولِ اللهِ
‘হে আল্লাহর রাসূলের ফুফু সাফিয়া’ বলে তাঁকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এতে বুঝা যায় যে, খালা ও ফুফু একই মর্যাদার অধিকারী।
পিতার বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক রাখা:
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাঃ বলেন,
إِنَّ مِنْ أَبَرِّ الْبِرِّ صِلَةَ الرَّجُلِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ بَعْدَ أَنْ يُوَلِّىَ-
‘সবচেয়ে বড় সদ্ব্যবহার হল পিতার অবর্তমানে তার বন্ধুদের সাথে সদ্ব্যবহার করা’।
এতে বুঝা যায় যে, পিতার সাথে সদ্ব্যবহারকারী সন্তান পিতার বন্ধুর কাছেও সদ্ব্যবহার পেয়ে থাকে। আর পিতার বন্ধুও তাকে নিজ সন্তানের মত স্নেহ করে থাকেন। এভাবেই সে সমাজে সম্মানিত হয়।
শেষ কথা হলো যে, পরিবার হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক স্তর। পরিবার যত আনুগত্যশীল ও পরস্পরে শ্রদ্ধাশীল হবে, সমাজ ও রাষ্ট্র ততো সুন্দর ও শান্তিময় হবে। পরিবার যতো উদ্ধত ও উচ্ছৃংখল হবে, সমাজ ততো বিশৃংখল ও বিনষ্ট হবে। অতএব পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের পারিবারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল সুন্দর সমাজ গঠনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। সাথে সাথে পিতা-মাতাকেও আল্লাহভীরু এবং সন্তানের শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য হতে হবে।
পাশাপাশি সন্তান হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ পিতা মাতা বেঁচে থাকেতে তাঁদের যথাসাধ্য খেদমতের মাধ্যমে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করা অথবা মৃত বাবা মা’র জন্য সবসময় দোয়া করা, যেন আল্লাহপাক তাঁদের জান্নাতে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে সন্তান হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের পিতা মাতার প্রতি  যথাযথ কর্তব্য পালনের সুযোগটুকু দান করেন। আমীন