ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ১০ ২০১৯, ১৪:১৭

এহসান বিন মুজাহির

বাংলা সাহিত্যে বিরল এক প্রতিভা সম্পন্ন কবি হলেন ফররুখ আহমদ। ১৯১৮ সালের ১০ জুন পুরাতন যশোরের মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানাধীন ‘মাঝ আইল’ গ্রামে বিখ্যাত সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খান বাহাদুর সৈয়দ হাতেম আলী। মাতার নাম বেগম রওশন আখতার। দাদির কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। দু’বছর গ্রামে তার সম্পর্কীয় দাদা মোল্লাজী আবদুস সামাদ পাঠদান করেন তাকে। তিনি কবির প্রথম শিক্ষক। তাঁর মেধার প্রখরতা দেখে সামাদ সাহেব তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। স্মৃতি ও সৃজনী শক্তি উভয়টাই ছিল প্রবল। এভাবে গ্রাম্য জীবনের লেখাপড়ার ইতি টেনে ফররুক চলে যান ‘তালতলা মডেল স্কুল’,কলকাতায়। কিন্তু মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ফররুখ কঠিন রোগ জলবসন্তে আক্রান্ত হন। অসুস্থতার কারণে তার পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করা সম্ভবপর হলো না। পরে তিনি খুলনায় চলে যান এবং খুলনা জেলার বালিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।

কবি ফররুর মেধা শক্তি ছিল প্রখর। ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। মেধাবী হওয়ার কারণেই তিনি ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিলেন এবং প্রায়ই ফাস্ট হতেন। খুলনা জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর রিপন কলেজ কলকাতা থেকে আই.এ. পাশ করেন (১৯৩৯ ইংরেজি )। তিনি স্কটিশ টার্চ ও সেন্টপল কলেজেও অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্ট কলেজে প্রথমে দর্শন এবং পরে ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে বি.এ তে ভর্তি হন। কিন্তু অনিবার্য কারণে তিনি অনার্স পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারেননি।
এখানে এসেই তার শিক্ষাজীবনের ছন্দপতন ঘটলো। তিনি লেখাপড়ার ইতি টানলেন। লেখাপড়ায় অগ্রসর হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করা তার পক্ষে সম্ভব হল না। কবি ফররুখ স্কুল জীবনে লেখাপড়ায় যেমন মত্ত থাকতেন বেশি সময়। ঠিক তদ্রুপ পাঠ্য বই ছাড়াও তিনি অন্যান্য বই অধ্যয়নে মগ্ন থাকতেন।

হাইস্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি বিভিন্ন পাঠাগারে নিয়মিত গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বই পাঠ করতেন। বই পাঠ করা তার কাছে ছিল নেশার মতো। নিজেও পাঠ করতেন, বন্ধু ও সহপাঠিদেরকেও বই পড়াতেন। প্রচুর লেখাপড়া করতেন। যখন মন চাইতো তখনই বসে যেতেন কাগজ-কলম নিয়ে। এমনকি প্রায়ই সারারাত নির্ঘুম থাকতেন। রাত জেগে লিখতেন, পড়তেন।
তবে লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটলেও কাব্য চর্চার ঝোঁক কিন্তু বহুগুণে বেড়েই চললো। কাব্য রচনার মাধ্যমে তিনি তার প্রতিভার বিকাল ঘটালেন।

ফররুখ আহমদের কাব্য প্রতিভা প্রাণ পেয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামী আদর্শ অবলম্বন করে। কবি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে তার সমস্ত চেতনা রাঙিয়ে তুলেছেন। ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি ফররুক আহমদ ইসলামের নিমজ্জমান সূর্যের পুনরাবির্ভাবের প্রত্যাশায় তিনি বিপ্লবী দামামা বাজিয়েছেন কাব্যভাষায়। পরাজয়ের গ্লানির সাগর পেরিয়ে পৃথিবীর বুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক এ স্বপ্ন দেখেছেন কবি ফররুক। তিনি ধর্মীয় অনুশাসনকে মনে প্রাণে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তিনি কখনো অনৈসলামিক, অসামাজিক ও ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী কোন কাজ করেননি।
একমাত্র ইলাহ আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত করেননি।

তার মনোবল ছিল মুসলমান কোন মানুষের সাহায্য চাইতে পারে না আল্লাহর সাহায্য ব্যতিত। কবি নীতি আদর্শকে কখনো জলাঞ্জলি দেন নাই। তিনি কপটতাকে পছন্দ করতেন না। মুসলিম সাহিত্য যখন নিভু নিভু প্রায়,বস্তুুবাদের নেশায় লেখকগণ যুক্তি তর্কেও দর্শন সাজিয়ে ভাববাদকে জলাঞ্জলি দিয়ে চলেছেন যখন লিখনীতে আস্তিকতার স্থান ছিল শুণ্যের কোটায়। রঙিন কলমের ডগায় যখন ইসলামী সাহিত্যকে কবর দেয়ার পায়তারা চলছে ফররুখ তখনই এলেন ইসলামী রেনেসাঁর কবি রূপে। ইসলামী মুল্যবোধ ছিল তার নিকট সবচেয়ে বেশি প্রণিধানযোগ্য। ধর্মের ক্ষেত্রে ছিলেন আপোষহীন। লোভ লালসার উর্ধ্বে ছিলেন তিনি। কারও প্রলোভনে কিংবা প্ররোচনায় পড়ে কিছু করতেন না। একজন মুসলমানের যা আদর্শ থাকা প্রয়োজন তিনি তা বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। শিক্ষাজীবনের বিরতির পর তিনি ১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিস এবং ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে ১ বছর চাকুরী করেন।

১৯৪৫ সালে মাসিক মোহাম্মদির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। এখানে এক বছর চাকুরী করেন। তিনি নিজেকে সর্বদা মুক্ত রাখতে ভালোবাসতেন। চাকুরীর ধরাবাধা নিয়ম কানুন তার নিকট ছিল অসহনীয়। তাই তিনি উভয় চাকুরীই ইস্তফা দিয়ে দেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরপরই তিনি প্রথমে অনিয়মিত এবং পরে নিয়মিত নিজস্ব শিল্পী হিসেবে রেডিও পাকিস্তান ঢাকায় চাকুরী নেন। এখানে বেশ কয়েক বছর সক্রিয়তার সাথে কাজ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। প্রধান কাজ ছিল কাব্য চর্চা। তিনি প্রচার শক্তি বা লিখনী শক্তির মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ প্রকাশকে প্রচারের হাতিয়ার মনে করতেন।

তিনি ছিলেন একজন আদর্শ সাহিত্য ও কাব্য এবং মানবতাবাদি কবি। তার প্রথম জীবন থেকেই তিনি কাব্য চর্চা করতেন। তার কবিতায় রোমান্টিকতা বাস্তবতা, বিদ্রোহী চেতনা ও ঐতিহ্যে উজ্জীবনের প্রেরণা কাজ করেছে। শব্দগুচ্ছ বাক-প্রতিমার শিল্প কবিতার উপজীব্য আভরণে, প্রতিকী উপস্থাপনায়, শব্দপ্রয়োগে সফল ও স্বার্থক। ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন এ জাতির প্রতি কবির বিস্ময়ভরা জিজ্ঞাসা, ‘দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা, তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?

তার কাব্য ক্ষেত্রকে নীরিহ দরিদ্র লোকদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতার মাধ্যমে অন্যায় অসত্যের প্রতিবাদ করতেন। কবি তার লেখনীর মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তার কবিতার একটি অংশ ‘ধ্বংসের নকীব তুমি হে দুর্বার, বৈশাখ সময়ের, বালুচরে তোমার কঠোর কন্ঠে শুনি আজ প্রকুন্ঠিত প্রলয়ের ডাক’ তিনি সাম্যবাদী আদর্শে গভীর বিশ্বাসি। তাই তিনি মানুষের মাঝে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান ভেঙে চুরমার করে দেয়ার জন্য কবিতায় গেয়ে ওঠেছেন, ইসলাম বলে সকলে সমান কে বড় ক্ষুদ্র কেবা, মানুষ ইসলাম বলে সকলে সমান, কে বড় ইসলাম বলে সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা, মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া নামিল শশী।

কবি কাব্য প্রতিভা দিয়ে বড়দের যেমন আকৃষ্ট করেছিলেন তেমনি আকৃষ্ট করেছিলেন ছোটদের মনকে। ছোটদের জন্যও লিখেছেন অনেক।

ফররুখের গ্রন্থাবলী: সাগরের মাঝি সিরাজাম মুনিরা, নৌফেল ও হাতেম তায়ী, নয়া জামাত, সিন্দাবাদ সংকলন, কাফেলা শিশু কিশোরদের জন্য ছড়ার আসর (১,২,৩ খন্ড), আলোকলতা, খুশির ছড়া, ছবির দেশে, মজার ছড়া, পাখির ছড়া, রংমশাল, হেরফের ছড়া। তিনি ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক