ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ’র পথচলার ৩২ বছর, অর্জন কি?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ১৪ ২০১৯, ১৫:৪৬

ডাঃ মোঃ ইব্রাহিম খলিল

১৯৮৭ সালের ১৩ ই মার্চ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের পথযাত্রা শুরু হয় রক্তাক্ত রাজপথকে সাক্ষী রেখে। শুরুর ইতিহাস ছিল রক্ত দিয়ে। দেশের ইসলামী রাজনীতির এক অধ্যায় সূচনা হয়েছিল দেহের তাজা রক্ত কুরবানির মধ্য দিয়ে।

দেখতে দেখতে বয়স হয়ে গেল ৩২ বছর, গতকাল ছিলো প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দিনটি অনেক কিছু স্মরণ করিয়ে দেয়। ইতিহাস সকলেরই জানা। এ্ইদিনে দিনে আমাদের ভাবতে হবে, দীর্ঘ পথচলার ৩২ বছরে আমাদের অর্জন কি, ব্যর্থতা কি? প্রাপ্তি কি, ঘাটতি সমূহ কি কি? আমাদের প্রাণের সংগঠন কি সঠিক রাস্তায় এগুচ্ছে নাকি ভুল পথে এগুচ্ছে?

আমার মতে,এইদিনে দিনটিতে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি উম্মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা করলে ভালো হত। যেখানে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের, অন্যান্য ইসলামী দলের কয়েকজন নেতাদের, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, আলেম ওলামাদের ডেকে তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হত, আপনাদের দৃষ্টিতে ইসলামী আন্দোলন কি সঠিক পথে হাঁটছে, বা আপনার কোন পরামর্শ দেবার আছে কি, বা আপনার দৃষ্টিতে ইসলামী আন্দোলনের আর কি করণীয় থাকতে পারে? এভাবে সকলের পরামর্শ নিলে, সংগঠনের অনেক উপকার হত, সকলের সাথে হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, সৌহার্দ্যতা বাড়ত। দলের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও জানা যেত।

আমি মনে করি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অর্জন অনেক। প্রথম অর্জন হচ্ছে, নীতি আর আদর্শ। নীতি আর আদর্শের দিক থেকে সবার উপরে আছে এটা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি। লোভ লালসা বা দুনিয়াবি কোন ক্ষমতার মোহে পড়েনি। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।

দলের অনেক নেতা কর্মী হয়েছে, এখন অনেক কর্মী, আগে যেখানে কমিটি করার জন্য একজন খুঁজে পাওয়া যেতনা, সেখানে একটি নয়, কয়েকটি সহযোগী সংগঠনগুলোর ফুল কমিটি, থানা কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি, ওয়ার্ড কমিটি আছে, আলহামদুলিল্লাহ। সকলেই সু-সংগঠিত, সু-শৃঙ্খল এবং দলের আমীরকে জানপ্রাণ দিয়ে মানে ও ভালোবাসে। আমীরের উপর সকলেই সন্তুষ্ট। এমন আমীর পেয়ে আমরা আনন্দিত, গর্বিত।

কথা হচ্ছে, আমাদের ত্রুটি বিচ্যুতি যে নাই তা নয়। অনেক আছে। আমাদের দায়িত্বশীল যারা তাদের আরো দায়িত্ববান হতে হবে, তাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে, তারবিয়াতের মাধ্যমে তাদের ঝালাই করে যুগোপযোগী করতে হবে। আমার মন বলছে, দল বাড়ছে, কিন্তু যোগ্যতাসম্পন্ন দূরদর্শীসম্পন্ন নেতা তৈরি হচ্ছেনা। একজন ভালো বলনেওয়ালা, লিখনেওয়ালা, জানলেওয়ালা জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে ম্যান পাওয়ার তৈরি হচ্ছেনা, একটা শূন্যতা থেকেই যাচ্ছে।

আমাদের মাঝে অনেকে একজন আরেকজনকে অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পারেনা, মান্যতা নাই, ছোটখাটো বিষয়গুলিকে আমরা অনেকবড় করে দেখি, এবং নিজেরা নিজেদেরকেই অনেকক্ষেত্রে শত্রু মনে করি, যার দৃষ্টান্ত অনেক দেওয়া যাবে। কমান্ড এর কিছুটা অভাব আছে। এসব চলতে দেওয়া যাবেনা, কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত দেয়, তা কঠোরভাবে মানতে হবে, মানাতে হবে, না মানলে ব্যবস্থা নিতে হবে।

দল এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, দিন যাচ্ছে এর কর্মী বাড়ছে, কেউ সিনিয়র কেউবা জুনিয়র হচ্ছেন। আমাদের সকলের মাঝে সম্পর্কের অভাব ছিলনা, ফেসবুক এসে আমাদের মাঝে সু-সম্পর্কের অভাব দেখা দিয়েছে। যেটাকে দূর করে সম্প্রীতি বাড়াতে হবে। সিণ্ডিকেটীয় আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব দূর করতে হবে।

আমরা প্রতিদিন নতুন নতুন কর্মীর পিছনে দৌড়াচ্ছি, শ্রম মেধা সময় অর্থ ব্যয় করছি। এটার পাশাপাশি আমার মতে, যারা পুরান হয়ে যে কোন কারণে দূরে সরে আছেন, বা যে কোন অভিমানে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন, আগে তাদের পিছনে সময় ব্যয় করে তাকে আবার দলে ভিড়ানোর ব্যবস্থা করলে দল আরো শক্তিশালী হবে। ৩২ বছরে যে পরিমাণে আমাদের নেতা কর্মী তৈরি হয়েছে, তাদের সকলকে যদি এক করা যায়, এক চিন্তা চেতনায় মিল করানো যায়, ইনশাআল্লাহ সফলতা বেশী দূরে নয়।

একজন কর্মী ২০/২৫ বছর দলের পিছে সময় ব্যয় করে, যৌবনের দামী সময়গুলো ব্যয় করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যায়, অথচ দলের দু-একজনের কারণে মনে প্রচণ্ড কষ্ট পেয়ে দূরে সরে থাকে, তার ভিতর যে চেতনা ছিল তা নিমিষেই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এসব দু-একজনকে চিহ্নিত করে দলের বৃহত্তম স্বার্থে এদের দূরে রাখতে হবে। এরা অনেকাংশে সম্ভবনার পথগুলোকে রুদ্ধ করে দেয়, এদের কারণে লজ্জায় কষ্টে অনেকে দূরে সরে থাকাটাই ব্যক্তিত্ব মনে করে।

গঠনমূলক টিকসই কাজ ছাড়া টিকে থাকা যাবেনা, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের এত কর্মী, এত লোকবল, এত নেতা, এত জনপ্রিয়তা, জনগণের আস্থা থাকা সত্ত্বেও, এত অনেক অনেক কিছু থাকার পরও কেন জানি কোথায় গিয়ে আটকে যাচ্ছি আমরা, রেজাল্টের সময় থমকে যাচ্ছি। এসব ভাবতে হবে, নতুন করে হিসেব কষতে হবে। বয়স কিন্তু কম হলনা, ৩২ চলছে। বিয়ের বয়স পেরেয়িছে, মনে করেন বিয়েও হয়ে গেছে, সন্তান হচ্ছেনা কিন্তু, কেন হচ্ছেনা, এখনই আমাদের থিসিস করে বের করতে হবে। এই বয়স হচ্ছে পূর্ণ যুবকের বয়স, কেন ফল আসবেনা? তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করতে হবে।

আমরা ভোটের রাজনীতি করিনা, কিন্তু ইসলামী রাজনীতি তো করছি। আমরাও কেন যেন গতানুগতিক রাজনীতিবিদদের মত ভোটের কয়েক মাস আগে গিয়ে এলাকায় হুলুস্থুল করে ফেলি, বাকীসময় আর খবর থাকেনা। ইসলামী রাজনীতি মানেই হচ্ছে উম্মাতের জন্য জাতির জন্য কিছু করা। শুধু ভোটের সময় কেন? বাকী সময় কেন এক্টিভিটি নাই? আমাদের আরো পরিকল্পনামাফিক এগুতে হবে। আমরা সত্যর বাণী নিয়ে গিয়েও ভোট পাইনা, আর ওরা হারামখোর হয়েও ভোট পায়, কারণ হচ্ছে, জনগণ তাদের সুখে দুঃখে আমাদের কাছে পায়না, ওদের পায়। জনগণের সাথে মিশতে হবে, তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।

জবাবদিহিতা নাই, একজন সভাপতি হয়েছেন, আছেন তো আছেনই, আর কেউ হবে বা অন্য কাহারও যোগ্যতা পরীক্ষা করার সুযোগ যে পাবে তা আর হয়ে উঠেনা। মনে হচ্ছে যিনি সভাপতি হয়েছেন, তিনিই খেলাফতপ্রাপ্ত খলিফা, আর কারো হবার সুযোগ নাই। যদি প্রতিবছর কঠোর জবাবদিহিতা নেওয়া হত, আগের সভাপতি দুই বছরে যা করেছে আপনি কেন তার থেকে বেশী করতে পারলেননা, তাহলে কাজ এগুতো।

জেলার দায়িত্বশীলদের মনের কথা শুনতে হবে মনোযোগ দিয়ে, তাদের দুঃখ বুঝতে হবে, কাজ কেন এগুচ্ছেনা, অন্তরায়গুলো কি কি? এসব জানার জন্য একটি টিম গঠন করতে হবে, সেই আলোকে সিদ্ধান্ত নিলে সংগঠন আরো বেগবান হবে। আমার কথাই বলি, নির্বাচন করলাম, খুব অল্প সময় পেয়েছি, তবুও একটা মিনিট নষ্ট করিনি, দৌড়িয়েছি, সকলের কাছে হাতপাখার দাওয়াত পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী করণীয় কি? কি করতে হবে আমাকে এখনো কেউ জিজ্ঞাসা করেনি, বা কোন পথ বাতলিয়ে দেয়নি। আমারও কিছু কথা ছিল, বলতে পারিনি কাউকে, বা ওভাবে ডাকেওনি কেউ, হয়ত সামনে ডাকবে, অপেক্ষায় আছি। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারাও আমার মতই বলল।

যাক, জন্মদিনে একটু আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছি, অনেক কিছু লিখতে মন চাচ্ছে, কিন্তু বেশী লিখলেও সমস্যা। মূল কথা হচ্ছে, মাঠে আমাদের ব্যাপক চাহিদা আছে, কিন্তু আমরা সেই মোতাবেক কাজ করতে পারছিনা কেন? যাচাই করার সময় এসেছে।

৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকিতে আমার প্রত্যাশা থাকবে,
ইসলামী দল বলতে মাঠে কেউ নাই, যারা একটু আধটু আছে, তারাও জনগণের কাছে পরিচিত নয়, বিতর্কিত হিসেবেই কারো কাছে ওরা পরিচিত। এই মুহূর্তে মাঠ খালি, জাতি একজন যোগ্য নেতা খুঁজছে। আমাদের যোগ্য নেতাও আছে, দরকার শুধু তৃণমূল পর্যায়ে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, জবাবদিহিমূলক কর্ম তৈরি করা।

ইসলামী আন্দোলন গণমানুষের দল হয়ে উঠুক,
মনে রাখার মত ইতিহাস রচনা করুক,
যে কোন সংগ্রাম আন্দোলনে প্রথম সারিতে উঠে আসুক,
ইসলামী আন্দোলনের ছায়া অনেক বিশাল হোক,
যেখানে মুক্তির ঠিকানা খুঁজে পাবে সকল শ্রেণীর জনগণ।