ইমরান বনাম মোদী : কাশ্মীর লড়াইয়ে জিতলেন কে?

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ০৩ ২০১৯, ১৮:৪৬

আবির আবরার:
পাকিস্তান তাদের হাতে আটক ভারতীয় পাইলট অভিনন্দনকে ছেড়ে দেবার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে গত কয়েকদিনের এই সঙ্কটে মানুষ যা দেখল বা বুঝল তাতে জিতল কোন পক্ষ? নরেন্দ্র মোদী আর ইমরান খানের মধ্যে কৌশলের লড়াইয়ে জিতলেন কে?

গত বৃহস্পতিবার (২৮শে ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সংসদে ঘোষণা করেন পাকিস্তান “শান্তির বার্তা” দিতে আটক ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেবে।

ইমরান খানের এই ঘোষণার সময় দিল্লিতে বিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মি: খানের ওই ঘোষণার কয়েক মুহূর্ত পরেই মি: মোদী পাকিস্তানকে বিদ্রূপ করে মন্তব্য করেন, “পাইলট প্রজেক্ট শেষ হল” এবং “এখন আমাদের আসল খেলায় নামতে হবে” (পাইলট প্রজেক্ট বলে তিনি পাইলটের ঘটনাকে একধরনের পরীক্ষা বলে ইঙ্গিত করে থাকবেন।) তার সমর্থকরা তার এই বক্তব্যে উল্লাস প্রকাশ করেছে, কিন্তু অনেকেই তার এই মন্তব্যকে রুচিহীন ও উদ্ধত মনে করেছে।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক এবং কৌশলগত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কে সি সিং বলেন মি: মোদীর বিজেপি দলে যারা কট্টরপন্থী এবং ভারতীয় প্রশাসনের “ইমরান খানের কূটনৈতিক রিভার্স সুইং-এর জবাব দেয়া কঠিন হবে।”

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মি: মোদী এমন একটা ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে তিনি তার বক্তব্য থেকে নড়েন না। আর তার জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তিকে আনুগত্যের সঙ্গে উজ্জীবিত রেখেছে স্থানীয় গণমাধ্যমে তার সমর্থক বড় একটা অংশ। এই পটভূমিতে অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যখন তার দেশ একটা ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে এবং পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে ভারত আশু যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে কিনা এধরনের জল্পনা বাড়ছে তখন মিস্টার মোদী নিজে কেন জাতির উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য না রেখে তার আমলা ও সেনাবাহিনীকে দিয়ে কথা বলাচ্ছেন।

ভারতের বড় বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অন্তত ২১টি দল মিস্টার মোদীর কড়া সমালোচনা করে বলেছে তার শাসনকালে ভারতে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সঙ্কট যখন চলছে তখন মিস্টার মোদী তার নির্বাচনী জনসভা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এমনকি মোবাইল অ্যাপ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাজিরা দেয়া থামাননি।

অনেকেই বলছেন পাকিস্তান দ্রুত পাল্টা হামলা চালিয়ে ভারতের জঙ্গী বিমান ভূপাতিত করে এবং বিমানের পাইলটকে আটক করে মিস্টার মোদীকে কোণঠাসা করে দিয়েছেন।

পাইলটকে বন্দী করার দুদিনের মধ্যেই ইমরান খান বৈরিতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন, শান্তির কথা বলেছেন এবং পাইলটকে মুক্তি দেবার ঘোষণা দিয়েছেন। কে সি সিং বলছেন বলছেন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নিজের “একটা সম্মানজনক ইমেজ তৈরি করেছেন এবং তিনি আলোচনার মাধ্যমে দুপক্ষের বিবাদ মীমাংসার জন্য তৈরি” এমন একটা ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন।

মিস্টার খানের ভারতীয় পাইলটকে ফিরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত সবাইকে অবাক করেছে।

মিস্টার খান তার দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে কথা বলেছেন, তার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং গণমাধ্যমকে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত অবহিত করেছেন।

ভারতের অনেক বিশ্লেষক বলছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিজেকে একজন “গ্রহণযোগ্য নেতা” হিসাবে প্রমাণ করেছেন, যিনি ভারতকে কোণঠাসা করার চেষ্টা না করে বৈরিতা বন্ধের একটা পথ প্রস্তাব করেছেন।

ঐতিহাসিক ও লেখক শ্রীনাথ রাঘাবান বলছেন, “আপনি যেভাবেই দেখার চেষ্টা করুন না কেন, পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারত হতচকিত হয়ে পড়েছে।”

বিবেচনার বিষয়টা হল- ১৪ই ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামার হামলায় ৪০জনের বেশি ভারতীয় আধাসামরিক সেনা নিহত হবার পর ভারত প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় রাতের অন্ধকারে। পাকিস্তান জবাব দেয় দ্রুত এবং সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে পরের দিনই একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে।

ভারতীয় পাইলট ধরা পড়ার ঘটনা যেহেতু ছিল অপ্রত্যাশিত, তাই এরপর মিস্টার মোদী ও তার সরকারকে দেখা যায় ভিন্ন সুরে কথা বলতে। তখন তাদের কাছে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পাইলটকে ভারতে ফিরিয়ে আনা। পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পর সেনাবাহিনী তাদের ব্রিফিং দেয় ৩০ ঘন্টা পর। মিস্টার মোদী ও তার সরকারের ব্যাখ্যা দেবার জায়গাটা স্পষ্টতই ছিল খুবই সীমিত।

পাকিস্তান ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর উস্কানি থেকে একটা নিরাপত্তা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া ভারতে নতুন কোন ঘটনা নয়। মিস্টার মোদীর আগে অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিংকেও একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। যেখানে আক্রমণ চালানোর সামরিক ক্ষমতা থাকলেও হিসাব করে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যাতে উত্তেজনার পারদ না চড়ে যায়। মিস্টার রাঘাবান বলছেন, “প্রতিশোধ কখনই কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে না। আবেগতাড়িত হয়ে কৌশল ঠিক করলে তা ব্যর্থ হবার বড়ধরনের সম্ভাবনা থাকে।”

ভারতের গণমাধ্যমগুলোর একটা বড় অংশ ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেবার ঘটনাকে মিস্টার মোদীর বিজয় হিসাবে তুলে ধরেছে। খুব কমজনই প্রশ্ন তুলছেন পুলওয়ামার হামলা গোয়েন্দা তথ্যের ব্যাপক ব্যর্থতার কারণে ঘটেছিল কিনা, কিংবা পাকিস্তান প্রকাশ্য দিবালোকে ভারতের প্রতিরক্ষা দুর্গ ভেদ করল কীভাবে?

এছাড়াও পাকিস্তানের ভেতর সন্ত্রাসীদের কথিত প্রশিক্ষণ শিবিরে ভারতীয় জেট হামলা চালিয়ে কতটা ক্ষয়ক্ষতি করতে পেরেছে সে চিত্রও এখনও স্পষ্ট নয়। ওই আক্রমণে ঠিক কতজন মারা গেছে সে বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখনও পরিষ্কার করে কিছু জানাতে পারেনি, যদিও গণমাধ্যমের একাংশ খোলাখুলিভাবে প্রায় ৩০০ জঙ্গী নিহত হবার খবর দিয়ে গেছে।

কাজেই এসব কঠিন প্রশ্ন নিয়ে মিস্টার মোদীর ভাবার সময় এসেছে এবং তার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে কিনা তা নিয়েও তার মাথাব্যথার কারণে তৈরি হয়েছে।

সে হিসেবে মিস্টার খান তার দেশবাসীর কাছে, এমনকি ভারতেও বহু মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের লড়াইয়ে জিতে গেছেন এট বলাই যায় ৷ কিন্তু মিস্টার মোদী ভারতে নিজের ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে যে পুরোপুরি হেরে গেছেন তেমনটা এখনই বলা যাবে না।