ইভ্যালির অস্বাভাবিক ব্যবসা: আলেমগণ কী বলেন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ২৮ ২০২১, ২২:৫৪

সম্প্রতি ‘ইভ্যালী ইকমার্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে মিডিয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। অনেকে জানতে চেয়েছেন এবিষয়ে আলেমদের অভিমত কী।

এ বিষয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলা হয় ঢাকার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকার মুদির মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহর সাথে। তিনি জানান, আমাদের দেশে ইভ্যালি যখন তার কার্যক্রম শুরু করে তখন মানুষ আমাদের কাছে মৌখিকভাবে এবং লিখিতভাবে জানতে চায়। মানুষ আমাদেরকে তাদের প্রতারণা সম্পর্কে যা বলে আমরা তাদের ওয়েব সাইটে এবং সাধারণভাবে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে সেগুলোর কিছু কিছু অংশ না পেয়ে প্রশ্নকারীদেরকে পাল্টা জিজ্ঞেস করি, তাদের প্রতারণাপূর্ণ বিজ্ঞাপনগুলো কোথায়। তারা আমাদেরকে তাদের ফেসবুকের লিঙ্ক দেন। আমরা সেখানে ইভ্যালির চটকদার বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে পাই। মানুষ সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানার জন্যে ওয়েবসাইটে ঢুকে। ইকমার্সগুলোর পরিচয় ওয়েবসাইটে থাকে। তো ইভ্যালি তার কিছু পরিচয় ওয়েব সাইটে দিল আর ফেসবুকে দিল তার আরো কিছু চটকদার পরিচয়- এ থেকে বোঝা যায় যে তারা কিছু জিনিস কিছু মানুষ থেকে লুকাতে চায়। এটা শরীয়া পড়াশোনা করা ছাত্র কেন যে কোনো বিবেকবান মানুষই বুঝতে পারার কথা যে, দাল মে কুছ কালা হ্যায়।

সাধারণত আমাদের দেশের ইকমার্সগুলোর পদ্ধতি, গ্রাহক পণ্য কেনার পর মূল্য পরিশোধ করবে। আগে থেকে তাদের কাছে গ্রাহকের একাউন্টে টাকা জমা রাখার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে ইভ্যালি বিভিন্ন সময় গ্রাহকদেরকে চটকদার অফার করে প্রলোভন দেখায় এবং ইভ্যালির নিকট অগ্রিম টাকা জমা রাখতে বলে।

এর দৃষ্টান্ত হল এমন যে, আপনি একটা দোকানে কোনো কিছু কিনতে যাবেন। দোকানদার আপনাকে বলল, আমার এখানে পন্য কিনতে হলে আমার কাছে আগে আপনার টাকা জমা রাখতে হবে। সেই জমা টাকা থেকে আপনি অমুক তারিখে অত দিন পরে আমার মাধ্যমে পণ্য এই এই সুবিধাসহ ভোগ করবেন। বলা বাহুল্য, এমন কারবার সাধারণভাবে কেউ মেনে নিবে না। কিন্তু আশ্চর্য ইভ্যালি এই কাজটিই দেশে প্রকাশ্যে দিনের পর দিন করে যাচ্ছে। মাত্র ৫০ হাজার টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে কিভাবে একজন মানুষ দেশের লক্ষ লক্ষ জনগণের কোটি কোটি টাকা জমা করছে দেশের বাণিজ্যমন্ত্রণালায়-অর্থমন্ত্রণালয়সহ এত এত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার নাকের ডগায় প্রশ্ন তোলেন মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ।

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহর কথা হল, শরীয়তে জায়েজ কি নাজায়েজ সেই প্রশ্ন পরে। যে প্রতিষ্ঠান প্রথমেই একথা বলে, পণ্য কেনার আগে এত টাকা দিন। পরে পণ্য দিব। সেই কোম্পানি পরিস্কার এক ধাপ্পাবাজ কোম্পানি। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এ কোম্পানির পদ্ধতি ভুল। শরীয়তও কখনো এজাতীয় কোম্পানির কারবারকে বৈধ বলে না। এই কোম্পানির সাথে লেনদেনকারী ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে, কোম্পানির অ্যাপ, ওয়েব সাইট, বিজ্ঞাপন পড়ে আমাদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, এই কোম্পানির কার্যক্রম শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো ব্যবসার মধ্যে পড়ে না। এ কথা আমরা আরো এক বছর আগেই বলেছি, যোগ করেন আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ।

কি কারণে ইভ্যালির কার্যক্রমকে শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয বলা হবে এমন প্রশ্ন করলে মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ বলেন, ইভ্যালির অনেক কারবারেই রিবা তথা সুদ বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে তারা বলে, আমাদের কাছে টাকা জমা রাখার এত দিন পর অমুক কম্পানির পণ্য খরিদে আপনি এত টাকা ডিসকাউন্ট বা ক্যাশব্যাক পাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, অগ্রিম টাকা জমা নেয়ার এ কৌশল কেন? সাধারণ অর্থনীতির দৃষ্টিতে অনেকে এখানে প্রতারণার ফাঁক খুঁজে পাবেন। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা এক প্রকার রিবা (সুদ)ও বটে। কারণ মানুষের টাকা নিজের কাছে ধার নিয়ে এর জন্য অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার চুক্তি করা হচ্ছে, যা সুস্পষ্ট নাজায়েয। তাদের কাজকর্মের প্রতারণার কথা যদি আপনি বাদও দেন তারপরও এখানে এই সুদ পাওয়া যাচ্ছে।

এই জাতীয় কারবার নাজায়েয হওয়ার আরো দলীল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসলাম চায় কেনাবেচার সময় ক্রেতা বিক্রেতা মূল্য ও পণ্য প্রাপ্তির মাধ্যমে একে অপর থেকে স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু ইভ্যালি জাতীয় প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতারণাপূর্ণ অফারগুলোর মাধ্যমে ক্রেতাকে স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে চায়। তারা এত এত পার্সেন্ট ক্যাশব্যাক ঘোষণা করে কিন্তু সেই ক্যাশব্যাকের টাকা গ্রাহকের হাতে তুলে দেয় না। বরং নিজেদের কাছে জমা রেখে অনেক দিন পর তার অংশ বিশেষের মাধ্যমে বিভিন্ন শর্তে বিভিন্ন জিনিস খরিদ করতে বলে। এধরণের শর্ত ও কৌশল ইসলামী শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

আমাদের দেশে অনেক কোম্পানি বিশাল বিশাল ক্যাশব্যাকের কথা বলে। যেমন, ৫০% ক্যাশব্যাক, ১০০% ক্যাশব্যাক। এসব ক্যাশব্যাক সম্পর্কে জানতে চাইলে এই আলেম বলেন, এসব বড় বড় ক্যাশব্যাকগুলো এক ধরণের প্রতারণা। তবে মানুষ সেগুলো মনে করে এটা তার ভাগ্য পরীক্ষা। স্ক্র্যাচকার্ড ঘষে ক্যাশব্যাক পেতে পারে আবার নাও পেতে পারে। এসব ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়, একটা কম্পানি একজন গ্রহককে কেন ভাগ্যপরীক্ষায় নিপতিত করবে? সে তো সরাসরি গ্রহককে ডিসকাউন্ট দিতে পারে। যত টাকা সে লটারির মাধ্যমে দিত তত টাকা ভাগ করে সকল গ্রহককে ডিসকাউন্ট দিক। এতে ভোক্তা সমাজ বেশী উপকৃত হবে।

ইভ্যালির ক্যাশব্যাক সম্পর্কে এই খ্যাতনামা ফকীহ আলেম বলেন, ইভ্যালি তো অনেক আগেই প্রতারণার সকল স্তর অতিক্রম করে গেছে। তারা যখন নিশ্চিত ১০০% ১৫০% ক্যাশব্যাক অফার দিয়েছে তখনই তো গণমাধ্যম এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর নড়েচড়ে বসা উচিত ছিল। এ কথা কি কেউ বুঝে না ১০০% ক্যাশব্যাকের অর্থ আপনি এক লাখ টাকা দিয়ে পন্য কিনলেন আর সেই এক লাখ টাকা বিক্রেতা আপনাকে ফেরত দিয়ে দিবে। আর দেড় শ পার্সেন্ট ক্যাশব্যাক দেয়ার মানে হল আপনার এক লাখ টাকার সাথে আরো ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত পাবেন। এ অংশকে ক্যাশব্যাক নাম দেয়া হলেও ব্যাক হচ্ছে না, বরং নিজের থেকে দেয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হল, ইভ্যালি কি কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান না গ্রাহকদের সাথে তার নিকটাত্মীয়তা আছে? আর তাদের পূর্বপুরুষরা কি বিলিয়নিয়ার ছিল ? তাদের তো কয়েক বছর ব্যবসা করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার কথা না যে গ্রাহককে ফ্রিতে লাখ লাখ টাকা বিলিয়ে দিবে? এখানেই আমাদের আক্ষেপ যে এক শ্রেণীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এ ধরণের জঘন্য কর্মকাণ্ডগুলোর ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়-অর্থমন্ত্রণালয় সজাগ থাকে না কেন? যাই হোক, ইসলামের দৃষ্টিতে নিশ্চিত ১০০% ক্যাশব্যাক বা তার চেয়ে বেশী ক্যাশব্যাকের কথা বললে এটা কোনো বেঁচাকেনাই হয় না। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা হিবা তথা ফ্রিতে বিনা পয়সায় দানের আওতায় পড়ে। কিন্তু বিভিন্ন শর্তের কারণে সেটাও বৈধ হয় না।

ক্যাশব্যাক নিয়ে তিনি আরো বলেন, যদি আপনি ১০০ পার্সেন্ট ১৫০% পর্যন্ত ক্যাশব্যাক দেন তার মানে আপনি মূল পুরো টাকা বা তার চেয়ে বেশী ফেরত দিলেন। তো টাকা নেওয়ারই দরকার কী ছিল, শুরুতেই পণ্যটা তাকে দিয়ে দিতেন। আপনার যদি পুঁজি থাকে, আপনি যদি পুঁজি থেকে ক্যাশব্যাক দিয়ে থাকেন তাহলে শুরুতে টাকাটা নাই নিতেন। আপনি এমনি দিয়ে দিতেন। আপনার প্রতিষ্ঠান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না হয়ে দানের প্রতিষ্ঠান হত। নাম দিলেন বেচাকেনা কিন্তু এখানে কাজ হল উল্টা। আপনি পণ্যও দিচ্ছেন আবার মূল্যও ফেরত দিচ্ছেন। বলেন আবুল হাসান আবদুল্লাহ।

এমন অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে লাভ দেয়ার ক্ষতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এককভাবে শুধু ইভ্যালি সম্পর্কেই বলছি না বরং এজাতীয় যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কথাই বলছি। দেশে ব্যবসার নাম দিয়ে এ জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের থাকা উচিত নয়। এতে করে সমাজের মূলধারার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূলধারার ব্যবসায়ীদের রক্ষা করতে এবং তাদের বিশাল কর্মীদের রক্ষা করতে দেশের দায়িত্বশীলদেরকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ আরো বলেন, ইভ্যালিসহ এ জাতীয় যেসব ব্যবসা মানুষকে অস্বাভাবিক অফারের প্রলোভন দেয় তাদের সবকটিকেই গোড়াতেই থামিয়ে দেওয়া উচিত। উচিত এ জাতীয় ভিত্তিহীন চটকদার ব্যবসাকে আইন করে নিষিদ্ধ করা। আমাদের দেশের অনেক মানুষ স্বল্প শিক্ষিত ও কিছুটা হুজুগ দ্বারা আক্রান্ত। প্রলোভন সৃষ্টিকারী ব্যবসার কর্তারা এটাকেই বড় রকম সুযোগ ও সুযোগের ক্ষেত্র মনে করে। তাই আইন করে ও গোড়া থেকে সরকারিভাবে সতর্কীকরণের পদক্ষেপ চালু থাকা দরকার। এক্ষেত্রে কঠোর নীতি প্রয়োগে গড়িমসি করলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় লাখ লাখ সাধারণ পর্যায়ের গ্রাহকদের। দেশে আইন করে বিজ্ঞাপনের ভাষার সীমা নির্ধারণ দিতে হবে। এবং আইন কঠোরভাবে পালন করাতে হবে। ঠিক করে দিতে হবে কতটুকু দেওয়া যাবে কতটুকু দেওয়া যাবে না কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করা যাবে। নয়তো এ ধরণের বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে সাধারণ মানুষ একদিকে যেমন প্রতারিত হবে অপরদিকে নাজায়েয কারবারে জড়িয়ে পড়বে। কিনবে হালাল পণ্য নিজের হালাল অর্থ দিয়ে কিন্তু পদ্ধতি ভুল হওয়ার কারণে গোনাহে লিপ্ত হয়ে যাবে।

এক কথায় পুরো কথার খোলাসা মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহর ভাষায়, এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কারবারে কোনো ক্ষেত্রে রিবা তথা সুদ পাওয়া যায়, কোথাও কিমার তথা জুয়া ও প্রতারণা পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে এখানে হাদীসে নিষিদ্ধ ‘বাইউন ও শরতুন’ ( ক্রয়বিক্রয় চুক্তির সাথে অপ্রাসঙ্গিক শর্ত) পাওয়া যায়। এসব কারনে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন করা নাজায়েয।

অনেক বিশেষজ্ঞ ইভ্যালির কার্যক্রমকে এমএলএমের মত মনে করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইভ্যালি ও এমএলএমের মধ্যে পদ্ধতিগত পার্থক্য রয়েছে। তবে গ্রাহক প্রতারণার দিক থেকে এটা আরো জঘন্য।

সবশেষে এ বিদগ্ধ আলেম বলেন, ইসলাম হচ্ছে স্বাভাবিক কল্যাণকর দ্বীন। ব্যবসা বা কারবার যুগ যুগ থেকে চালু ছিল। ইসলাম আসার আগে থেকেই ব্যবসা চলে আসছে। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঐসব নীতি ও বিধান বহাল রেখেছে যা কল্যাণকর। সাথেসাথে আরো বহু এমন নিয়ম নীতিও ইসলাম আরোপ করেছে, যা ক্রেতাবিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম অনেক বিধিনিষেধও আরোপ করেছে, যেগুলোর সবটাই ক্রেতা অথবা বিক্রেতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে উভয়ের স্বার্থপরিপন্থী। সুতরাং মুসলমানদেরকে তাদের দৈনন্দিন কারবারে ইসলামী শরীয়ার নীতি অনুসরণ করতে হবে। তাতেই তারা এ জাতীয় ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারবে।

সৌজন্যে: ইসলাম টাইমস ২৪ ডটকম