ইতিহাসে রক্তদান: করণীয় ও বর্জনীয়

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ২৪ ২০২০, ১২:১৬

তাহসিন আহমাদ

সারা পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ রক্ত দান করে অন্যের জীবন বাঁচায়। সেই ১৮১৮ থেকে আজ ২০১৯পর্যন্ত সকল রক্তদাতাকে গভীর শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। এ বছর বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: “Safe blood for all” স্লোগানকে ধারণ করে দিবসটি পালনের host country হলো রুয়ান্ডা। তারা রক্তদানকে উৎসাহিত করার জন্য এবং রক্তদাতাকে একটি “Thank you!” নোট দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আমার কাছে এই “Thank you!” ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কারণ প্রকৃত রক্তদাতা কোনো কিছুর বিনিময়ে রক্ত দেন না, শুধুমাত্র মানসিক আত্মতৃপ্তি ছাড়া।

রক্তদানের ইতিহাস:

অস্ট্রিয়ান ফিজিশিয়ান কার্ল ল্যান্ডেস্টেইনারের জন্মদিন ছিল ১৮৬৮ সালের ১৪ জুন। এই দিনটি ২০০৪ সাল থেকে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে সারা পৃথিবীতে পালন করছে—যৌথভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট। ২০০৫ সালে WHO এর ৫৮তম অধিবেশনে দিনটিকে অফিসিয়ালি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

মূলত সতের শতাব্দী থেকে রক্ত চিকিৎসার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৬২৮ সালে ব্রিটিশ ডাক্তার উইলিয়াম হার্ভে “রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বা Blood circulation” আবিষ্কার বা উপস্থাপন করেন। এর পরপরই স্বল্প পরিসরে Blood transfusion এর চেষ্টা চালানো হয়।

১৬৬৫ সালে পৃথিবীর সর্বপ্রথম প্রাণীতে ব্লাড ট্রান্সফিউশন করা হয়েছিল ইংল্যাণ্ডে। চিকিৎসক রিচার্ড লওয়ার সর্ব প্রথম কুকুর থেকে কুকুরে এটি করে প্রমাণ করেন যে, এটা সম্ভব। এর প্রায় দেড়শ বছর পর ১৮১৮ সালে জেমস ব্লান্ডল মানুষ থেকে মানুষে রক্ত পরিসঞ্চালন করেন। (PPH এর চিকিৎসায়)। এর ধারাবাহিকতায় ১৯০০ সালে কার্ল ল্যান্ডেস্টেইনার ABO blood group (A, B, O) আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার জিতে নেন। এর দুই বছর পর তার সহকর্মীরা ৪র্থ গ্রুপ “AB” আবিষ্কার করেন। এ পথ ধরে ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয় “Cross matching”। এর মাধ্যমে সরাসরি রক্তদাতা এবং গ্রহীতার রক্ত সুন্দরভাবে মিশে যাচ্ছে নাকি কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে তা দেখা যায়। ১৯১৪ সালে এডলফ হাস্টিন সোডিয়াম সাইট্রেটকে Anti-coagulant হিসেবে প্রমাণ করেন এবং দেখান যে, এটি দিয়ে রক্ত সংরক্ষণ এবং পরবর্তীতে ট্রান্সফিউশন সম্ভব। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৩২ সালে লেনিংগ্রাড হাসপাতালে পৃথিবীর সর্ব প্রথম blood bank প্রতিষ্ঠিত হলেও আমেরিকার শিকাগোর কুক কান্ট্রি হাসপাতালের পরিচালক বার্নার্ড ফন্টাস সর্বপ্রথম এই “Blood Bank” শব্দটি ব্যবহার করেন। এখন সারা বিশ্বে এই নাম ব্যবহৃত হচ্ছে।

১৯৩৯-৪০ এর দিকে ট্রান্সফিউশনের অন্যতম উপাদান Rh typing আবিষ্কৃত হয় অর্থাৎ এর মাধ্যমে রক্ত পজিটিভ (+ve) বা নেগেটিভ (-ve) তা জানা যায়। তখন আমেরিকাতে সরকারিভাবে রক্ত সংগ্রহ করার প্রোগ্রাম চালু হয়।

আগে রক্ত সংগ্রহ করা হতো কাচের বোতলে। ১৯৫০ থেকে চালু হয় প্লাস্টিকের ব্যাগে রক্ত সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ। ১৯৬১ সালে ক্যান্সারের রোগীদের রক্তক্ষরণের (Hemorrhage) চিকিৎসায় Platelet transfusion ( অনুচক্রিকা পরিসঞ্চালন) শুরু হয়। ১৯৭০ সালে “Volunteer blood donor” পদ্ধতি চালু হয়, যাতে সাধারণ-সুস্থ মানুষ বছরে ৩ বার স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে পারে। আবার রক্ত থেকে রক্তের বিভিন্ন উপাদান আলাদা করার প্রক্রিয়া—যাকে বলে Apheresis, চালু হয় ১৯৭২ সালে। এতে রক্ত নিয়ে রক্তের প্রয়োজনীয় উপাদান আলাদা করে নিয়ে বাকি রক্তটুকু আবারো রক্তদাতাকে ফেরত দেওয়া হতো। দাতার রক্তে HIV আছে কিনা তা জানতে HIV screening শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। আর Hepatitis- C screening শুরু ১৯৯০ থেকে।

এখন আমাদের দেশে রক্ত দানের পূর্বে কিছু টেস্ট করা হয়। তা হল: Hb%, Hepatitis- B,C; MP (Malaria), TPHA ( Syphilis) এবং HIV – এই পাঁচটা রক্তবাহিত রোগ।

এখন জেনে নেওয়া যাক, রক্তের কি কি উপাদান সাধারণত দেওয়া হয়:
Whole blood, Packed Cell (RBC Concentrate), Fresh Frozen Plasma (FFP), Platelet Transfusion ইত্যাদি। রক্তের ঘাটতি হলে Whole blood, শুধু RBC ঘাটতি থাকলে দেওয়া হয়। Packed cell, Coagulopathy তে দেওয়া FFP (কারণ তাতে clotting factor গুলো থাকে)। Bleeding disorder হলে দেওয়া হয় Platelet. যেমন: ডেঙ্গু।

এখন কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর জানা যাক:

কাদের রক্ত লাগে?

মোটা দাগে ৩ শ্রেণীর রোগীদের রক্তের প্রয়োজন।
১. দুর্ঘটনা: Road traffic Accident (RTA), Burn, Assault ইত্যাদি।
২. Major oparation: Splenectomy, Thyroidectomy, Histerectomy, Cesarean Section (মাঝে মাঝে), হার্টের অপারেশন (CABG) ইত্যাদি।
৩. রক্ত রোগ: Thalassemia, Leukemia, Aplastic Anemia ইত্যাদি।

কারা রক্ত দিতে পারবে/পারবে না?
১. বয়স: ১৮-৫৫ বছর বয়সী যে কোনো সুস্থ মানুষ।
২. যাদের রক্ত বাহিত অসুখ নাই।
৩. ভ্যাক্সিন দিলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রক্ত দেওয়া যায় না।
৪. ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, থায়রয়েডের অসুখ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকলে দেওয়া যায়।
৫. মেয়েদের ক্ষেত্রে menstruation, গর্ভাবস্থা এবং Lactiation বা Breast feed করানোর সময় সীমার মধ্যে দেওয়া যায় না।
৬. নিজেই এনিমিয়া বা রক্ত রোগে ভুগলে দেওয়া যাবে না।
৭. মানসিক রোগীর কাছ থেকে নেওয়া যাবে না।
৮. মাদকাসক্তদের থেকেও নেওয়া যাবে না।

রক্ত দেওয়ার পূর্বে করণীয় কী?
১. অবশ্যই রক্তদাতার পালস, প্রেশার, তাপমাত্রা মাপতে হবে।
২. রক্তদানের পূর্বে ১৫-৩০ মিনিটি বিশ্রাম করতে হবে।
৩. Screening এবং Cross matching করতে হবে।

রক্তদানের সময় করণীয়:
মানসিকভাবে ধীরস্থির থাকা এবং হাতের মধ্যে দেওয়া স্পঞ্জের বল বা অন্য কিছু আস্তে আস্তে পাম্প করা, এতে রক্ত সহজে ব্যাগে চলে যাবে।

রক্তদানের পরবর্তীতে করণীয়:
এক গ্লাস গ্লুকোজের শরবত পান এবং ১৫-৩০ মিনিট বিশ্রাম। ভয় অনুভূত হলে বা খারাপ লাগলে মনকে বারবার বলা যে “আমার রক্তে আরেকজনের জীবন বাঁচবে।”

রক্ত দিলে কোনো ক্ষতি হয়?
উত্তর: না। ৬০ কেজি ওজনের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষে প্রায় ৮০০ মিলি রক্ত বেশি থাকে। আর নেওয়া হয় শুধুমাত্র ৪০০ মি.লি. অর্থাৎ আরো অতিরিক্ত ৪০০ মিলি থেকেই যায়।

 

কত দিন পরপর রক্ত দেওয়া যায়?
চার মাস (১২০ দিন, লোহিত কনিকার বয়স)। অর্থাৎ বছরে চার বার। তবে শুধু প্লেটলেট বা অনুচক্রিকা ৭-১০ দিন পরপরই দেওয়া যায়।

কত সময় লাগে রক্ত দানের ঘাটতি মিটতে?
রক্তের তরল অংশ – প্লাজমা ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পুরণ হয়ে যায়, আর WBC (শ্বেত কনিকা) – ১-৩ সপ্তাহ, Platelet (অনুচক্রিকা) ৭-১০ দিন আর RBC (লোহিত কনিকা) ১২০ দিনের মধ্যে পুরণ হয়ে যায়। আমাদের মূল লক্ষ্য থাকে ওই RBC এর ঘাটতি মেটানো।

কাদের রক্ত নেওয়া সবচেয়ে ভাল?
পরিবারের মানুষের রক্ত সবচেয়ে ভাল। না পেলে আত্মীয়-স্বজন বা অন্য সুস্থ স্বেচ্ছায় রক্তদাতার। তবে কোনো ক্রমেই মাদকাসক্ত বা পেশাদার রক্তদাতার রক্ত নেওয়া উচিত নয়।

বাংলাদেশে রক্তদানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে ছাত্র সমাজ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের অগণিত ছাত্র-ছাত্রী নিঃসংকোচে, নির্দ্ধিধায়, নির্ভয়ে, নিরবে নিভৃতে রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচিয়ে চলেছেন।

তবে এমন মহৎ কাজে যুক্ত থাকা উদার মানুষদের জাতীয়ভাবে কোনো পুরস্কার বা স্বীকৃতি—সম্মাননা দেওয়া হয় না। এটা দুঃখজনক। রুয়ান্ডা তাদের রক্তদাতাদেরকে উৎসাহিত করতে ব্যাপক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমাদেরও উচিত তেমনিভাবে এই সকল রক্তাদাতাদের উৎসাহিত করা বা সম্মান জানানো। আমার পরিচিত একজন ৩৫ বছর বয়সে ৪৯ বার রক্ত দিয়েছেন। এদের নিয়ে পত্রিকায় ফিচার হওয়া উচিত।

সবশেষে আজকের এই লেখা বাংলার সকল রক্তদাতাদের উৎসর্গ করে ইতি টানলাম।

সুন্দর ও স্বচ্ছন্দময় হোক রক্তদাতাদের জীবন।

 

[সূত্র : বিদেশী ওয়েবসাইট অবলম্বনে]