ইতিকাফ নিয়ে জরুরি কিছু কথা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ০৩ ২০২১, ১৫:২৭

মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান: ইতিকাফের শাব্দিক অর্থ, কোনো স্থানে অবস্থান করা। আর শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয়, নির্দিষ্ট শর্তের সাথে মসজিদে অবস্থান করা। আর তা হলো, জাগতিক কার্যকলাপ ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একমাত্র সওয়াবের নিয়তে মসজিদে বা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা।

বিশ রমযান মাগরিবের পূর্ব হতে ঈদের চাঁদ উদয় হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করার নাম ইতিকাফ। এই ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া অর্থাৎ একজন ব্যক্তি যদি আদায় করে, তাহলে সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। নতুবা সবাই সুন্নত ত্যাগ করার জন্য গোনাহগার হবে।

আল্লামা শামী রহ. বলেন—‘ইতিকাফ হচ্ছে সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এর ব্যাখ্যায় তিনি এই ইতিকাফকে সুন্নতে কিফায়া বলে উল্লেখ করেছেন। তাই ফরজ এবং ওয়াজিব কিফায়ার যে হুকুম, সুন্নতে কিফায়াও একই হুকুম।’

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. বলেন— ‘ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। তবে ইতিকাফের মানত করলে তা ওয়াজিব হয়ে যায়। আর শুধু অন্তরে নিয়ত করলে মানত বলে গণ্য হবে না, বরং মুখে উচ্চারণ করে মানতের নিয়ত করলে তা ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।’

ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইতিকাফ

আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে রোযার মতোই ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে ইতিকাফের বিধান থাকার কথা। তবে পূর্বেকার নবীদের যুগে ইতিকাফের বিধান কেমন ছিল, তা বলা মুশকিল। তবে হযরত দাউদ আ. ও হযরত মুসা আ. সহ বিভিন্ন নবী ও তাদের উম্মতের জীবনী থেকে ইতিকাফের সন্ধান পাওয়া যায়। এমনকি বিধর্মীদের মধ্যেও ইতিকাফের নিয়ম ছিল বলে হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায়। হযরত উমর ফারুক রা. একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিগ্যেস করলেন—ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি জাহেলি যুগে ‘মসজিদুল হারামে’ এক রাত ইতিকাফের মানত করেছিলাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার মানত পূরণ করে নাও।

এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, হযরত উমর রা. অমুসলিম থাকা অবস্থাতেও ইতিকাফের মানত করেছিলেন। পবিত্র কুরআনেও উল্লেখ আছে—‘তাওয়াফ ও ইতিকাফকারীদের জন্য আমরা ঘর পবিত্র করো।’

এ আয়াত থেকেও পূর্বকালে ইতিকাফের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে তাদের ইতিকাফের উদ্দেশ্য এবং ধরন ছিল ভিন্ন। কিন্তু ইসলাম ইতিকাফকে প্রথাগত প্রচলন না করে বিশুদ্ধ ইবাদতে পরিণত করেছে এবং অন্যান্য ইবাদতের মতোই ইতিকাফের জন্য বিভিন্ন ধরনের শর্তাবলি আরোপ করেছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। এমনকি রাসুলের স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন।’

ইতিকাফের ফযিলত

কুরআনে কারীমে ১২ মাসের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে একমাত্র রমযান মাসের কথা উল্লেখ আছে। রমযানের প্রতিটি দিন-রাত, প্রতিটি মুহূর্ত বরকতময় ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। পূর্ণ মাসই যেন সওয়াবের অসাধারণ প্যাকেজ। বিশেষ করে রমযানের শেষ দশকে আল্লাহর অগুণতি রহমত উম্মতের ওপর বৃষ্টির মতো অবিরাম বর্ষিত হতে থাকে। এই দশকেই সাধারণত শবে কদর এসে থাকে। তাই এই দশকের ইতিকাফে বিশেষ ফযিলত রয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এই দশকে ইতিকাফ করেছেন এবং ইতিকাফকারীদের অসংখ্য সওয়াবের সংবাদ দিয়েছেন।

তিনি এক হাদিসে বলেন, ‘ইতিকাফকারী ব্যক্তি যাবতীয় গোনাহ হতে নিজেকে মুক্ত রাখে। এবং তাকে এমন সওয়াবের প্রতিদান দেয়া হয়, যেমন দেয়া হয় সর্বক্ষণ ইবাদতে মশগুল ব্যক্তিকে।’

আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তার এবং জাহান্নামের মধ্যে তিনটি গহ্বর সৃষ্টি করবেন, যার দূরত্ব আসমান ও জমিনের দূরত্ব অপেক্ষা অধিক হবে।’

ইতিকাফের শর্ত

ইতিকাফের জন্য শর্ত হচ্ছে, এমন মসজিদে ইতিকাফ করতে হবে, যেখানে নামাযের জামাত হয়। জুমা হোক বা না হোক। এ শর্ত পুরুষের ইতিকাফের ক্ষেত্রে। মুস্তাহাব হলো, ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম মসজিদ নির্বাচন করা। সর্বোত্তম মসজিদ যেমন মসজিদুল হারাম তারপর মসজিদে নববী, তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস, তারপর যে জামে মসজিদে জামাতের ব্যবস্থাপনা আছে, তারপর মহল্লার মসজিদ। তারপর যে মসজিদে বড় জামাত হয়।

তবে মহিলাদের জন্য মসজিদে ইতিকাফ করা মাকরুহে তাহরীমি। তারা ঘরে ইতিকাফ করবে। স্বামী থাকলে ইতিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। স্বামীর খেদমতের প্রয়োজন থাকলে ইতিকাফে বসবে না। শিশুর তত্ত্বাবধান ও যুবতী কন্যার প্রতি খেয়াল রাখার প্রয়োজনীয়তা থাকলে ইতিকাফে না বসাই সমীচীন। মহিলারা নির্দিষ্ট কোনো কামরায় বা ঘরের কোণে একস্থানে পর্দা ঘিরে ইতিকাফে বসবে। মহিলাদের জন্য ইতিকাফের অন্যান্য মাসায়েল পুরুষের মতোই। তবে মহিলাদের ঋতুস্রাব শুরু হলে ইতিকাফ ছেড়ে দিবে।

ইতিকাফের জন্য ইতিকাফের নিয়ত করা আবশ্যক। কারণ, নিয়ত ছাড়া প্রত্যেক কাজের শুধু অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে না।

ইতিকাফের প্রকার

ইতিকাফ তিন প্রকার। এক, ওয়াজিব ইতিকাফ, যা ইতিকাফের মানতের নিয়ত করার কারণে ওয়াজিব হয়ে যায়। দুই, সুন্নতে কিফায়া, যা রমযানের শেষ দশকে আদায় করতে হয়। তিন, নফল ইতিকাফ, যা রমযানের শেষ দশকে ছাড়া যে কোনো সময়ে করা যায়। চাইলে রমযানের পহেলা তারিখ থেকে বিশ তারিখ পর্যন্ত নফল ইতিকাফ করতে পারবে।

ইতিকাফের সময় কতটুকু?

নফল অথবা মুস্তাহাব ইতিকাফের জন্য মসজিদে কতটুকু সময় অবস্থান করা জরুরি, এ সম্পর্কে ‘তানবিরুল আবসার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, নফল ইতিকাফ সামান্য সময়ের জন্যও হতে পারে। অর্থাৎ কেউ যদি এক মিনিট বা আধা মিনিটও মসজিদে ইতিকাফের নিয়তে অবস্থান করে, তাহলে তা ইতিকাফ বলে গণ্য হবে। এ কারণে উলামায়ে কেরাম বলেন, নামাযের জন্য মসজিদে প্রবেশের সাথে সাথে ইতিকাফের নিয়ত করে নেয়া। এতে করে নামাযের সাথে সাথে নফল ইতিকাফের সওয়াবও পাওয়া যায়।

পক্ষান্তরে ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অধিক সময় অবস্থানের ব্যাপারে কোনো সীমা নেই। কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলে সারা জীবন ইতিকাফ করে কাটাতে পারবে। কিন্তু ‘সাওমে বেসাল’ বা ইফতার না করে অনবরত রোযা রাখা কিংবা ‘সাওমে দাহর’ অর্থাৎ সারা বছর রোযা রাখা ইসলামি দৃষ্টিতে যেরূপ অপছন্দনীয়, তেমনিভাবে জাগতিক সব কিছু বিসর্জন দিয়ে পরিবার-পরিজনের দায়দায়িত্ব ছেড়ে সারা বছর ইতিকাফ করাও অপছন্দনীয়। এবং এটি মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ চাহিদাও বটে। তবে জীবনের কখনো যদি কেউ লাগাতার ইতিকাফ করতে চায় আর এতে পরিবার-পরিজনের অথবা অন্যদের হক ও প্রয়োজনীয় কাজকর্মের অসুবিধা না হয়, তাহলে এটি প্রশংসার্হ।

উপরে আলোচনা হয়েছে, নফল ইতিকাফের সময়সীমা নিয়ে। সুন্নতে কিফায়া ইতিকাফ কেবল রমযান মাসের শেষ দশ দিন করতে হয়, অন্য সময় নয়। আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহ. বলেন, (তিন প্রকারের দ্বিতীয় প্রকার ইতিকাফ হলো) সুন্নতে কিফায়া। এটি রমযানের শেষ দশকে আদায় করতে হয়। এই ইতিকাফ নয় দিনেরও হতে পারে। কারণ, অনেক সময় রমযান ২৯ দিনের হয়।

আর ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য ন্যুনতম সময় হলো একদিন। এর চাইতে কম সময়ের জন্য ইতিকাফের মানত হয় না। তবে অধিক যত দিনের ইচ্ছা, তত দিনের ইতিকাফের মানত করা যায়। কিন্তু যে সব দিনে রোযা রাখা নিষেধ, সে সব দিনে ইতিকাফের মানত করা জায়েজ নেই। কারণ, মানত ইতিকাফের সময় রোযাও রাখতে হয়। রোযা ছাড়া মানতের ইতিকাফ আদায় হয় না।

ইতিকাফের আমল

ইতিকাফে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত করা শর্ত নয়। যে কোনো নফল নামায, যিকির-আযকার, তেলাওয়াত, দ্বীনী কিতাব পড়া, পড়ানো বা যে ইবাদত মনে চায় করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকে অধিক রাত জেগে ইবাদত করতেন। পরিবার-পরিজনকেও জাগিয়ে দিতেন এবং ইবাদতের জন্য অধিক মেহনত করতেন।’

তাই আমাদের উচিত, ইতিকাফ অবস্থায় অধিক ইবাদত করা। এছাড়াও তেলাওয়াতে ‍কুরআন, নফল নামায, তাহাজ্জুদের নামায, দ্বীনী কিতাব পড়াশোনা ও দ্বীনী মাসআলা-মাসায়েল আলোচনা ইত্যাদি করা যেতে পারে। এ সময়ে উমরি কাযা আদায়ের জন্য এটি একটি উত্তম ও সূবর্ণ সুযোগ। তাসবিহ-তাহলিল আদায়েরও উত্তম সময়। অতএব, অনর্থক কথাবার্তা বলা মোটেই উচিত নয়।

মনে রাখতে হবে, অনর্থক কথাবার্তার দ্বারা নেকিসমূহ এমনভাবে নষ্ট হয়ে যায়, যেমন আগুন ভষ্ম করে দেয় কাঠের টুকরাকে। আল্লাহ আমাদের সকলকে রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ ও বেশি বেশি আমলের তওফিক দান করুন। আমীন।

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে পড়তে পারেন মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান হাফিজাহুল্লাহ রচিত ‘রমযানের হাদিয়া’ এবং ‘মাসায়েলে রমযান ও ঈদুল ফিতর’ গ্রন্থ দুটি। বই দুটি পাওয়া যাবে যাত্রাবাড়ি মাদরাসা সংলগ্ন কিতাব মার্কেটে এবং বাংলাবাজারের মাকতাবাতুল আবরারে।