আবুল আ’লা মওদূদী এবং আবুল হাসান আলী নাদভী: একটি তুলনামূলক পাঠ -০৫

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ০৮ ২০১৯, ২০:১৬

।। মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত ।।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।

এই তুলনামূলক পাঠের চারটি পর্বে ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা ও জাহিলিয়া, শারিয়া ও জিহাদ প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তক ও লেখকের বয়ানের মূলসূত্র ও উদ্ধৃতিসহ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।

আজকের পর্বে খিলাফাত ও মুলুকিয়াত প্রসঙ্গে ইসলামের এই দুই দিকপালের চিন্তা তাদের রচনা থেকে উদ্ধৃতিসহ উপস্থাপিত হচ্ছে। লেখাটি বেশ বড়। আশা করি যারা আগ্রহী তারা ধৈর্য হারাবেন না। অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তবে শুধরে নিতে কোন কার্পণ্য করব না। ধন্যবাদ।

৮. খিলাফাত ও মুলুকিয়াত

মওদূদী – খিলাফাত ধারণাটি ইসলামের ইতিহাসের একটি অনুষঙ্গ। প্রাথমিক পর্যায়ে এর অর্থ করা যায় এভাবে যে এরা হলেন রাসুল স. এর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরসূরি বা খিলাফাতে রাসুলুল্লাহ। [১] কাজেই এই ইতিহাস-বিধৃত পরিভাষাটি কোরআন অবতরণের পরবর্তীকালের ভাষা ও প্রত্যয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ হল রাসুল স. এর এই উত্তরসূরিরা সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক নিয়োজিত হননি। তারা নিয়োজিত হয়েছিলেন উম্মাহর নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। এরা ছিলেন রাসুল স. এর মৃত্যুর পরে মুসলিম উম্মাহর শুরা কর্তৃক নির্বাচিত বৈধ ও স্বীকৃত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

রাসুল স. এর মৃত্যু পরবর্তী ইতিহাসের একজন পর্যালোচনামূলক পর্যবেক্ষক ও গবেষক ছিলেন মওদূদী। বিশেষ করে তৃতীয় খলিফা হজরত উসমানের নেতৃত্ব ও শাসনকালের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত ভাষ্যের সমালোচনামূলক ভাষ্য রচনা করেছিলেন। আর প্রথম উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়া সম্পর্কে তিনি আরো কঠোর সমালোচনামূলক মূল্যায়ন ও মন্তব্য করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তার এই প্রথাবিরোধী পর্যালোচনা ও সমালোচনা অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

মওদূদীর কাছে মানুষ কর্তৃক নেয়া সিদ্ধান্ত দ্বীনি বৈধতার প্রশ্নে যথেষ্ট ছিল না। তিনি একারণে খিলাফাত প্রত্যয়টিকে আল্লাহর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে দেখতে চাইতেন। তিনি খিলাফাত বিষয়ে কোরআনের সুরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াতের ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে খিলাফাত প্রত্যয়ের একটি সাধারণ সংজ্ঞায় উপনীত হয়েছিলেনঃ “Khalīfa is one who, in a certain dominion [mulk], exercises the powers [ikhtiyārāt] conferred upon him in the capacity of a deputy [nāʾib kī ḥaythiyyat]. A khalīfa is no Master [mālik] [by himself], but basically the Master’s deputy. His powers are not essentially [dhātī] his own, but were bestowed to him by [his] Master. In reality, he cannot act on his own intent, but his works are entirely done on the Master’s purport.” [২]

কোরআনের সমর্থন নিয়ে মওদূদী এখানে দুটি লক্ষ্য পূরণ করেছেন। প্রথমতঃ তিনি তার খিলাফাত ধারণাটিকে ইসলামের ইতিহাসের খিলাফাত ধারণা থেকে অবমুক্ত করলেন; অর্থাৎ রাসুল স. এর উত্তরসূরি হিশেবে যে খিলাফাতের ধারণা তা থেকে আলাদা করলেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি খিলাফাত ধারণাটিকে কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের প্রতিভূ আল্লাহর সঙ্গে মানুষের একটি বিশেষ সম্পর্ক হিশেবে দেখলেন ও বুঝলেন। কাজেই মওদূদীর খিলাফাত ধারণা যতটা ধর্মতাত্ত্বিক ততটা ইতিহাস নির্ভর নয়। তার খিলাফাতের প্রত্যয় হল খিলাফাতুল্লাহ – অর্থাৎ এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব ও আস্থার ধারক ও বাহক হিশেবে বিশ্বাসী মানব বা মুমিন। খিলাফাতে রাসুলুল্লাহর ধারণা থেকে খিলাফাতুল্লাহর এই ধারণা নিঃসন্দেহে আলাদা। আর আমরা জানি খিলাফাতে রাসুলুল্লাহর ধারণাটি এসেছে ইসলামের ইতিহাস থেকে রাসুল মুহাম্মাদ স. এর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তরসূরি হিশাবে। [৩] এই পার্থক্য বিচারটি অবশ্য একেবারে অভিনব কিছু নয়। মধ্যযুগের উত্তর আফ্রিকার বহুমুখী প্রতিভাধর মুসলিম মনীষী ইবনে খালদুন (মৃ. ১৪০৮) খিলাফাতের এই দুই প্রত্যয়ের মধ্যে একটি ভিন্নতা ইতিপূর্বেই নির্দেশ করেছিলেন। তিনি মূর্ত খিলাফাত (খিলাফাত বি আতলাক) এবং বিমূর্ত খিলাফাত (খিলাফাত আল আম্মা) এই দুই পরিভাষা ব্যবহার করেছিলেন এই সূত্রে। [৪]

মওদূদীর কাছে ইতিহাস নির্ভর খিলাফাতের প্রাসঙ্গিকতা ছিল ততক্ষণ যতক্ষণ তা তাকে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অবক্ষয় ও পতনের কারণ ও ফলাফল অনুসন্ধানে ইতিহাসের পুনর্পাঠে সহায়তা করেছে। ইতিহাসের এই পুনর্পাঠের মাধ্যমে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে আল্লাহর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্ব থেকে যখন মানবের দুনিয়াবী বিষয়ের বিধি-বিধানের দূরত্ব তৈরি হয়েছে তখনই আল্লাহর প্রতিনিধি এবং আস্থা রক্ষক হিশেবে মানবের পতন শুরু হয়েছে। [৫] ইতিহাসের এই পুনর্পাঠ এবং পুনর্বিবেচনার আলোকে মওদূদীর কাছে খিলাফাতে রাসুলুল্লাহর ধারণাটি বেশি আকর্ষণীয় মনে হয় নি। কারণ তিনি কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের যে নির্দেশনামূলক রাজনৈতিক তত্ত্ব তৈরি করতে চেয়েছেন তার জন্য খিলাফাতুল্লাহর প্রত্যয়টিই তার কাছে বেশি উপযোগী এবং কার্যকর বলে মনে হয়েছে।

মওদূদী খিলাফাত প্রত্যয়টিকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিভাষা হিশেবে বুঝেছিলেন। অর্থাৎ তিনি এই প্রত্যয়টিকে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার বৈধতা দেয়ার একটি কার্যকর দ্বীনি উপায় হিশেবে বিবেচনা করেছিলেন। এভাবে তার বোঝাপড়া রাজনীতির কোঠায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কোরআনের আন-নূর সুরার ৫৫ নম্বর আয়াতটিঃ “God has promised those of you who believe and work righteous deeds [amanū minkum wa-ʿamilū al-ṣāliḥāt] to make them khulafāʾ on earth [la yastakh li fannahum fi’l-arḍ], just as He has made those who lived before them to khulafāʾ.”

এই আয়াতের ব্যাখ্যা করে তিনি তার যুক্তিবিন্যাসে সেটি প্রয়োগ করেছিলেন। তার মতে এটাই হল কোরআনের সেই আয়াত যা “sheds an extraordinarily clear light on the Islamic theory of state [riyāsat].” [৬] তিনি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আরো বলেছেন যে এখানে একটি মানব সমষ্টির কথা বলা হয়েছে যারা সকলে মিলে এই খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করবে। সুরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াতের চাইতে সুরা আন-নূরের এই আয়াতের পার্থক্য হল এখানে বলা হয়েছে যে খিলাফাতের মর্যাদা পেতে হলে একটি যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে হবে – সেটি হল যারা ইমান আনবে এবং তদনুযায়ী আমল করবে কেবল তারাই এই মর্যাদার অধিকারী হবে।

এরপরে মওদূদী ইসলামের ইতিহাসের সেই বিশেষ পর্বটি যা খিলাফাতে রাশেদীন নামে পরিচিত সেই পর্বটিকে রাসুল স. এর উত্তরসূরিতার উজ্জ্বল উদাহরণ হিশেবে সামনে নিয়ে আসেন। তিনি এই খিলাফাতের গণতান্ত্রিক অনুশীলনকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেন। এর ভেতর দিয়ে মদীনার খিলাফাতে রাশেদীনকে তিনি একটি দ্বীনি দৃষ্টান্ত হিশেবে দেখান; বিশেষ করে শুরার মাধ্যমে এই খিলাফা্তের নির্বাচন প্রক্রিয়া মওদূদীর জন্য একটি অনুসরণযোগ্য নীতি বলে পরিগণিত হয়। এই নীতির আলোকে খলিফারা উম্মাহর দ্বারা সমালোচিত হতে পারতেন এবং তারা উম্মাহর কাছে জবাবদিহি করতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতেন।

ইবনে খালদুনের ‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে যেভাবে খিলাফাত ও মুলুকিয়াতের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য টানা হয়েছিল মওদূদী পরিভাষাগত সেই বিভাজনকে অনুসরণ করে ১৯৬৬ সালে ‘খিলাফাত ও মুলুকিয়াত’ শিরোনামে একটি বই লেখেন। এই বইতে তিনি ইসলামের ইতিহাসের খিলাফাতে রাশেদীনের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে খিলাফাত প্রত্যয়টিকে মুলুকিয়াত প্রত্যয়ের একটি বিপরীত প্রত্যয় হিশেবে উপস্থাপন করেন। তার মতে যেহেতু কোরআনে মালিক শব্দটি আল্লাহর একটি গুণ হিশেবে অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে, এবং যা প্রখ্যাত অনেক মুফাসসির অনুসমর্থন করেছেন, সেহেতু কোন মানুষ যদি নিজেকে মালিক বলে পরিচয় দেয় তবে তা নিজেকে দৈবসত্তা বলে বিবেচনার শামিল হবে। এটি হবে পরিস্কারভাবে আল্লাহর অধীনতা অস্ব্বীকার করা যা তাঁর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে গণ্য হবে। মওদূদী লিখেছেনঃ “If someone begins either to see himself as the Master [mālik] or to use the powers that were conferred upon him in whatever manner he pleased [man-māne ṭarīqe se], or if he, instead of the True Master, acknowledges someone else as master, follows his aims and executes his rules [aḥkām], then these would be considered as acts of treachery and revolt [ghaddārī awr baghāwat ke af ʿāl].” [৭]

‘খিলাফাত ও মুলুকিয়াত’ গ্রন্থে মওদূদী দেখিয়েছেন যে কিভাবে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (মৃ. ৬৮০ খ্রি.) উমাইয়া রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী খিলাফাতের মৌলিক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করেছিলেন। [৮] মওদূদী জোর দিয়ে বলেছেন যে সঠিক হেদায়েতপ্রাপ্ত খিলাফাতে রাশেদীন ইসলামের দিব্য-গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধকে উচ্চকিত করে তুলে ধরেছিল। [৯] কিন্তু এই চেতনা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটতে শুরু করে প্রথম ফিতনার সময় থেকে অর্থাৎ ৬৫৮-৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এই দিব্য-গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধই হল খিলাফাতের নির্যাস; এই নির্যাস কোরআন দ্বারা সমর্থিত এবং সে কারণে খিলাফাত হল মুলুকিয়াতের বিপ্রতীপ প্রতিকল্প। খিলাফাতই হল সামাজিক ন্যায়বিচারের গ্যারান্টর এবং মাসলাহা বা সাধারণ কল্যাণে অবদানকারী। অন্যদিকে মুলুকিয়াত হল এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

এভাবে সঠিক হেদায়েতপ্রাপ্ত খিলাফাতে রাশেদীন থেকে বেইনসাফী মুলুকিয়াত বা রাজতান্ত্রিক শাসনে অবনমন মওদূদীর ইসলামের ইতিহাস চেতনার আরেকটি প্রমাণ ও সাক্ষী। তার ইসলামের ইতিহাস চেতনা ছিল ক্রমাগত অবনতি ও পতনের চেতনা। এভাবে তার এই ইতিহাস চেতনায় চলে আসে ইসলাম ও জাহিলিয়ার সেই ধ্রুপদী দ্বন্দ্বের মত আরেকটি বয়ান। এক্ষেত্রে এই ইতিহাস হল খিলাফাত ও মুলুকিয়াতের দ্বন্দ্বের মহা আখ্যান। আর মুলুকিয়াত বলতে তিনি শুধু মুসলিম ইতিহাসের উমাইয়া, আব্বাসী, ফাতিমী, মামলুক বা উসমানী রাজবংশ গুলিকেই নির্দেশ করেননি; তিনি এর আওতায় পরবর্তীকালের ও সমকালের সব ধরণের মানব-রচিত শাসন ব্যবস্থাকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাদেরকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন যারাই আল্লাহর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্বের বরখেলাপ করেছে। এক্ষেত্রে বিগত দুশ বছরের আধুনিক কালের জাতীয়তাবাদ, উদার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ, কমিউনিজম এসবই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

নাদভী – মওদূদী ও নাদভীর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিহিত আছে তাদের চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির পার্থক্যের সূত্র। মওদূদী ছিলেন একজন প্রথাবিরোধী, স্বাধীনচেতা ইসলামের পর্যবেক্ষক, পর্যালোচক, মৌলিক চিন্তক, লেখক ও রাজনীতিক। অন্যদিকে নাদভী ছিলেন মূলত একজন প্রথানুসারী কিন্তু গুণ-মান-পদ্ধতি বিষয়ে আপসহীন একজন বিশিষ্ট শিক্ষক, পন্ডিত, গবেষক ও আরবী বিশারদ লেখক। তাদের এই ব্যক্তিত্ব ও কিছু প্রেক্ষাপটের পার্থক্যের কারণে খিলাফাত ও মুলুকিয়াত বিষয়ে দুজনের মৌলিক মিল থাকলেও তাদের পর্যালোচনার তীব্রতায় ও প্রকাশভঙ্গীতে বেশ পার্থক্য দেখা গিয়েছে। যেমন নাদভীও মওদূদীর মত খিলাফাতে রাশেদীনকে ইসলামের একটি সোনালী সময় হিশেবে চিত্রিত করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “খেলাফাতে রাশেদা ছিলো এমনই এক আদর্শ শাসনযুগ, যার চেয়ে উত্তম ও সমৃদ্ধতর আর কিছু কল্পনা করারও উপায় ছিল না।” [১০]

কিন্তু নাদভীর কাছে খিলাফাতে রাসু্লুল্লাহ হিশেবে খিলাফাতে রাশেদীন যত গুরুত্বপূর্ণ ছিল মওদূদীর কাছে ততটা ছিল না। কারণ মওদূদী ইসলামের একটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা রচনা করেছিলেন। সেখানে আল্লাহর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্ব ধারণার উপর নির্ভর করে একটি ভবিষ্যমুখী নতুন ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি একটি তাত্ত্বিক কাঠামো প্রস্তাব করেছিলেন। এই ইসলামী রাষ্ট্র পুনরায় একটি নতুন খিলাফাত হিশেবে বিকশিত হবে এটাই তার রূপকল্প ছিল। তার কাছে তাই কোরআনের আলোকে খিলাফাতুল্লাহর প্রত্যয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

প্রথমত: নাদভীর এমন কোন মননশীল ও সৃজনশীল রুপকল্প তৈরির দায় ছিল না। কাজেই খিলাফাত প্রত্যয়ের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে তার কোন সুস্পষ্ট প্রাধিকারও ছিল না। দ্বিতীয়তঃ ব্যক্তিত্ব, প্রস্তুতি ও লক্ষ্যের ভিন্নতার কারণে নাদভীর ইসলামের ইতিহাস চেতনা তুলনামূলকভাবে বেশি প্রথানুগ ছিল; তা প্রচলিত ও স্বীকৃত বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল না। তিনিও মনে করতেন যে খিলাফাতে রাশেদীন থেকে উমাইয়া মুলুকিয়াত বা রাজতন্ত্রে অবনমনের মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর অবক্ষয় ও পতনের সূচনা হয়েছিল। তিনি লিখেছেনঃ “মুসলিম উম্মাহর জীবনে অবক্ষয় ও অধঃপতনের সূচনা ছিলো বেশ স্পষ্ট। এমনকি যদি উন্নতি ও অবনতির মধ্যবর্তী পার্থক্য-রেখাটির উপর অঙ্গুলিনির্দেশ করতে বলা হয় তাহলে অতি সহজেই আমরা সেই ঐতিহাসিক রেখাটি চিহ্নিত করতে পারবো যা খিলাফাতে রাশেদা ও আরব-মুসলিম শাসনকে পৃথক করে রেখেছে।” [১১]

উম্মাহর জীবনে মুলুকিয়াত বা রাজতন্ত্রের অশুভ প্রভাব সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- “…মানবজাতির দুর্ভাগ্য এই যে, খিলাফাতে রাশেদার পর ইসলামী উম্মাহর ইমামাতের মহাগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার ক্রমে এমন লোকদের দখলে চলে গেলো যারা কোনভাবেই এর যোগ্য ছিলো না এবং এজন্য তাদের যথাযথ প্রস্তুতিও ছিলো না। … … … ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ ও ভাবধারায় তারা এতটা আত্মস্থ ছিলো না, ইসলামী উম্মাহর নেতৃত্বদানের জন্য যা ছিলো অপরিহার্য। জিহাদী চেতনা ও ইজতিহাদী যোগ্যতা কোনটাই তাদের ছিল না, যা ইসলামী খিলাফাতের গুরু-দায়িত্ব বহন এবং বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য ছিলো জরুরী। আর এটা উমাইয়া ও আব্বাসী উভয় খিলাফাতের ক্ষেত্রেই ছিলো প্রায় সমান সত্য।” [১২]

কিন্তু এইসব মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে নাদভী প্রচলিত ও স্বীকৃত বয়ানের সঙ্গে কোন দ্রোহমূলক ও সাংঘর্ষিক বয়ানের অবতারণা করেন নি। এই কারণে তিনি প্রথানুসারী উলামাদের কাছে তুলনামূলকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য, স্বীকৃত ও অবিতর্কিত।

রেফারেন্স:
[১] খিলাফাত শব্দের বিভিন্ন অর্থ পর্যালোচনার জন্য দেখুন, Patricia Crone and Martin Hinds (1986). God’s Caliph: Religious Authority in the First Centuries of Islam, Cambridge: CUP. Pages 4 — 23
[২] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৪৯–৭২), তাফহিমুল কুরআন, ৪ খন্ড, লাহোরঃ ইদারা ই তরজুমানুল কুরআন, পৃ. ৭০
[৩] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৭), খিলাফাত ওয়া মুলুকিয়াত, দিল্লী: মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামী, পৃ. ৯৬, ১৯৬- এবং ২৩৫
[৪] Ibn Khaldūn, ʿAbd al-Raḥmān (1320h). al-Muqaddima li’l-ʿAllāma Ibn Khaldūn, al-Fāsī, Aḥmad ibn Saʿīd (ed.), Cairo: al-Bulāq, Page 181
[৫] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৭), খিলাফাত ওয়া মুলুকিয়াত, দিল্লী: মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামী, পৃ. ৯৬ – ১৪৪
[৬] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৭২) ইসলাম কা নজরিয়া কি সিয়াসি, দিল্লী: মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামী, পৃ. ৩৮
[৭] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৪৯–৭২), তাফহিমুল কুরআন, ১ম খন্ড, লাহোর: ইদারা ই তরজুমানুল কুরআন, পৃ. ৬২
[৮] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৭), খিলাফাত ওয়া মুলুকিয়াত, দিল্লী: মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামী, পৃ. ১৪৫—৬১
[৯] প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৩—৯৫
[১০] সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদাবী (২০১৩), মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো? অনুবাদ: আবু তাহের মেসবাহ, ঢাকা, দারুল কলম, পৃ. ২১৮
[১১] প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৭
[১২] প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৩

(চলবে ইনশাআল্লাহ)