আফ্রিকায় প্রথম আজান উচ্চারিত হওয়া মসজিদ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ০৩ ২০২১, ১৭:৪৭

মুফতি মুহাম্মদ তাসনীম: নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বজুড়ে ইসলামি জ্ঞানচর্চা বেড়ে চলছিল। সেই সঙ্গে ধর্ম চর্চা অর্থাৎ কোরআন-হাদিসের প্রতি মানুষের আগ্রহও বাড়তে থাকে। ওই সময়ের অন্যতম সমৃদ্ধ নগর ছিল উত্তর অফ্রিকার তিউনিসিয়ার কায়রোয়ান শহর। যা বর্তমানে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষিত।

মুসলিম দিগ্নিজয়ী উকবা বিন নাফ কায়রোয়ান জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারে মসজিদের নাম রাখা হয় উকবা বিন নাফে মসজিদ। উকবা ইবনে নাফি ছিলেন আরব জাহানের একজন নামকরা সেনাপতি। এই স্থাপত্য নিদর্শন পশ্চিমা ইসলামি বিশ্বের সব মসজিদের পূর্বসূরী হিসেবে বিবেচিত।

উকবা মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় ৬৭০ সাল মোতাবেক ৫০ হিজরির দিকে। পরবর্তীতে মসজিদ ভবনটি টিকিয়ে রাখার জন্য চালানো হয় সংস্কারকাজ। অর্থাৎ টিকে থাকার মতো স্থাপনা নির্মাণ করা হয় এবং তা করা হয় প্রায় নবম শতকে। অবশ্য বেশ পরে যোগ করা হয় মসজিদের স্থাপনার কিছু অংশ।

এই মসজিদ থেকে আফ্রিকা মহাদেশে প্রথম আজান উচ্চারিত হয়। এ কারণে ইসলামের ইতিহাসে এটির গুরুত্ব অপরিসীম। ওই সময়ের পশ্চিম ইসলামিক দুনিয়ার প্রথম মসজিদ বলেও এটি স্বীকৃত। পরবর্তীকালে এটি পশ্চিমে স্থাপিত অন্যান্য মসজিদের মডেলে পরিণত হয়। অর্থাৎ বিভিন্নস্থানে প্রচুর মসজিদ নির্মাণ করা হয় উকবা মসজিদের আদললে। কারণ, এর নকশা যেমন আকর্ষণীয় তেমনি মজবুত এর ভিত্তিপ্রস্তর। আরবরা মাগরিব (পশ্চিম ইসলামিক দুনিয়া) বলে থাকে- আলজেরিয়া, মরক্কো ও তিউনিসিয়াকে।

উকবা মসজিদটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে একটি শক্তিশালী দুর্গ মসজিদটিকে বেষ্টন করে রেখেছে। কায়রোয়ান মসজিদে ৫টি গম্বুজ ও ৯টি প্রবেশ দ্বার রয়েছে। এই মসজিদের মেহরাবের কাছে নীচু ছাদবিশিষ্ট আরেকটি কক্ষ রয়েছে। যার নাম মাকসুরা। খলিফাদের নামাজ আদায় এবং তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এই বিশেষ কক্ষ মাকসুরা নির্মাণ করা হয়েছিল। এই কক্ষের ভেতরে দাঁড়িয়ে মসজিদে অবস্থানরত মুসল্লিদের দেখা যাওয়ার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে এক জামাতে নামাজ আদায় করা যেত।

ইসলামের ইতিহাসে হজরত মুয়াবিয়া (রা.) সর্বপ্রথম দামেস্কের উমাইয়া জামে মসজিদে মাকসুরা নির্মাণ করেন। কায়রোয়ান জামে মসজিদের প্রাচীর নির্মাণ করা হয় ইট ও পাথর দিয়ে। এই প্রাচীরের ভেতরেই তৈরি করা হয়েছে বড় বড় স্তম্ভ। এই মসজিদের মিনারে যে চমৎকার কারুকাজ রয়েছে, আফ্রিকার অন্যকোনো মসজিদে তার নজির পাওয়া যায় না।

যারা মুসলিম নন, শুধুমাত্র মসজিদটি দেখতে এসেছেন- তারা মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন। তবে মূল মসজিদের ভেতরে (নামাজের স্থান) প্রবেশের অনুমতি নেই। বাইরে থেকে জানালার ভেতর দিয়ে নামাজ কক্ষ দেখতে পারবেন, প্রয়োজনে ছবি তোলার অনুমতি আছে। বিদেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, মসজিদটি দেখতে আসেন। নারী দর্শনার্থীকে মসজিদে প্রবেশ করতে চাইলে মসজিদের সম্মানার্থে মাথা ঢেকে যাওয়া আবশ্যক, তিনি ভিন্নধর্মী হলেও।

এই মসজিদের সৌন্দর্য বেশ আকর্ষণীয়। কায়রোয়ান শহর বুননশিল্পের জন্য খুব পরিচিত। অসংখ্য পর্যটক শুধুমাত্র বিচিত্র ও চমকপ্রদ মাদুরের সন্ধানে এখানে আসেন। মসজিদ সংলগ্ন বাজার বুননশিল্পী, রৌপ্যকার ও স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পোষাক প্রস্তুতকারকদের গুঞ্জনে মুখরিত থাকে। শহরের পুরাতন অংশে সরু গলি এবং আঁকাবাঁকা পথ দেখা যায়। যার দুই ধারে রয়েছে সার দেওয়া সাদা চুনকাম করা বাড়ি।

২৭ হিজরি সনে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর খেলাফতের সোনালি শাসনামলে তিউনিসিয়া ইসলামি শাসনে আসে। খলিফা উসমান রা.-(এর) শাসনামলে মুসলমানরা এদেশ জয়ের পর ‘কায়রোয়ান’ শহরের পতন ঘটে। মুসলিম বাহিনীর মহান সেনাপতি উকবা ইবনে নাফে ফাহরি (রা.) গভীর চিন্তা-ভাবনার পর শহরটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।

আফ্রিকার এই অংশটি মুসলিম শাসনাধীন আসার পর উকবা ইবনে নাফে এখানে বড় বড় ইসলামি পন্ডিত উলামা-বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশের আয়োজন করেন।

তবে ১৯ শতকের শেষের দিকে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স তিউনিসিয়ার ওপর হামলা চালিয়ে তা দখল করে নেয়। প্রায় পৌনে এক শতক পর্যন্ত তিউনিসিয়ার ওপর ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন বহাল থাকে। এই দীর্ঘকাল ফ্রান্সের শাসনাধীন মরক্কো এবং আলজেরিয়া ইত্যাদি এলাকার মতো ফরাসী ভাষাই এখানকার সরকারি ভাষা হিসাবে চালু থাকে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপিয়ান কৃষ্টি-কালচারের প্রাধান্যও দেশটিতে বৃদ্ধি পায়।

তা সত্ত্বেও এই পুরাতন নগরীর আনাচে-কানাচে মধ্যযুগের সেই ইতিহাস, ইসলামি স্থাপত্য ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের স্মৃতি রোমন্থন কায়রোয়ান শহরকে অন্যমাত্রা ও মর্যাদা দেয়।