আন্দোলন-সংগ্রামের পথে জুলুম, কারাগার ও শাহাদাত

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

এপ্রিল ২৩ ২০২১, ২২:৩২

ফুজায়েল আহমাদ নাজমুল: ইসলামী সমাজ বিপ্লবের নেতাকর্মীরা বরাবরই মজলুম। জালেমদের জুলুমের শিকার হতে হয় তাদের প্রতিনিয়ত। শারিরীক আবার কখনো মানসিক। কখনো কারাগারে বন্দি হতে হয় এবং কাউকে সেখানে বছরের পর বছর থাকতে হয়। রিমান্ডের নামে অনেক জুলুম সহ্য করতে হয়। ফাইনাল সময়ে কখনো ফাঁসির রশিতে ঝুলে শাহাদাতের পেয়ালাও পান করতে হয়।

এ সত্য জেনেই ইসলামী সমাজ বিপ্লবের নেতাকর্মীদের যাত্রা পথের শুরুতেই নিজের সংকল্পকে জুলুম নির্যাতন সহ্য করার জন্য আরো শক্তিশালী করে নিতে হয়। প্রতিটি মুহুর্তে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে সাহায্য কামনা করতে হয় এবং আল্লাহর কাছে সত্যের সৈনিকদের সংরক্ষিত যে পুরস্কার রয়েছে তা থেকে উৎসাহ উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা গ্রহণ করতে হয়।

এ কথা মনে রাখতে হবে যে, জুলুম-কারাগার ও শাহাদাত আন্দোলন-সংগ্রামের পথে এক অপরিবর্তিত চিরাচরিত নিয়ম। আজ এগুলো আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়, বরং আদিকাল থেকেই এর ধারাবাহিকতা চলে আসছে। হজরত আদম আ. থেকে বিশ্বনবী সা. এবং বিশ্বনবী থেকে আজ পর্যন্ত সর্বযুগেরই ইতিহাস তা সাক্ষ্য দেয়। আগামীতেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না।

আম্বীয়ায়ে কেরামদের যুগে সত্যের দাওয়াত দিতে গিয়ে হজরত ইব্রাহিম আ.-কে নমরুদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছিলো। হজরত মুসা আ.-কে ফেরাউনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিলো। হজরত ঈসা আ. -কে বনী ইসরাইলদের হাতে নির্যাতিত হতে হয়েছিলো। হজরত ইউসুফ আ.-কে কারাগারের অন্ধকারে জুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিলো। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সা.-কে জালেম, তাগুতসহ সকল জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত হতে হয়েছিলো। ওহুদের ময়দানে তাঁর দাঁত মুবারক শহীদ হয়েছিলো।

জালেম, ফাসেক শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে মহানবীর প্রিয়তম দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রা. ও তাঁর পরিবারের প্রায় সব পুরুষই সত্যের জন্য নিজেদের শির দিয়েছিলেন। কারবালার প্রান্তরে নির্দয়, পাষান সীমার হুসাইন রা. এর মস্তিস্ক দ্বি-খন্ডিত করে হিংস্রতা ও বর্বরতার আশ্রয় নিয়ে তাকে অপমান করে এবং শেষপর্যন্ত তিনি শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছিলেন।

সত্যকে গ্রহণ করার কারণে হজরত বেলাল রা.-কে আরব মরুর উত্তপ্ত বালু-পাথরকুচি ও জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর পাথর চাপা দিয়ে শাস্তি দেয়া হয়েছিলো। তাঁর গলায় রশি লাগিয়ে টানাহেঁচড়া করা হয়েছিলো শহরের অলিতে গলিতে। এসব নির্যাতনের পরও তিনি সত্যের পথ থেকে চুল পরিমাণও সরে যাননি। বরং নির্যাতনের মধ্যে থেকেও চিৎকার করে ‘আহাদ-আহাদ’ বলে তাওহীদের ঘোষনা দিয়েছিলেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা. ছিলেন একজন প্রতিভাধর তরুণ সাহাবী ও প্রখ্যাত মুজাহিদ ফকিহ। তিনি মারওয়ানী শাসকদের অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং একটি সত্যিকার খেলাফত কায়েমের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামেও লিপ্ত ছিলেন। শেষপর্যন্ত তিনি আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের জালেম গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।

হজরত জায়েদ ইবনে আলী রা. উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আব্দুল মালেকের বিরুদ্ধে জেহাদী পতাকা উত্তোলন করেন এবং শেষপর্যন্ত নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।

ইমাম আবুহানিফা রহ. বনী উমাইয়া ও বনু আব্বাসী শাসকদের বিরুদ্ধে ভুমিকা পালন করেছেন। কখনো তাদের সাথে আপোষ করেননি। জোর জবরদস্তি ও অত্যাচার করা সত্বেও তিনি কোন সরকারী পদ গ্রহণ করেননি। এজন্য উমাইয়া আমলে তাঁকে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করা হয়েছিলো। খলিফা মনসুরের আমলে তাকে কারাগারে বন্দী করা হয়েছিলো। তবুও তিনি বাতিলের সামনে নতি স্বীকার করেননি।

ইমাম মালেক রহ. একসময় খলিফা মনসুরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। তখন জালেমরা তাঁকে বেত্রাঘাতের দন্ড প্রদান করে এবং এর ফলে তাঁর কাঁধের উপরের একটি অংশ স্থানচ্যুত হয়ে যায়। তাছাড়াও তাঁকে নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়েছিলো।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. জালেমদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলেন। ফলে তাঁকেও কারাগারে যেতে হয়েছিলো। শেষপর্যন্ত কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন।

ভারতবর্ষে আলেম সমাজ অসংখ্য জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়ে কতটুকু জেহাদী ভুমিকা রেখেছিলেন ইতিহাস তার জ্বলন্ত প্রমান।

১৬০১ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা ব্যবসার নাম নিয়ে ভারতবর্ষে আগমন করেছিলো। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তারা দেড়শত বছরের অধিককাল পর্যন্ত রাজত্ব চালায়। মানুষদের শোষণ করে। একসময় তারা ইসলামের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। তখন ইংরেজদের করতলে দেশ ছিলো অবরুদ্ধ। জাতি ছিলো বৃটিশ আগ্রাসনে নিস্পেষিত। সকল মজলুমদের এক অভিন্ন আহাজারী ছিলো বৃটিশ বেনিয়াদের শাসক নামের শোষণ থেকে মুক্তি পাবো কবে?

দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে উলামায়ে কেরাম তথা ইসলামী আন্দোলনের অগ্রসৈনিকেরা তখন ইসলামের শত্রু ইংরেজদের মোকাবেলায় ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে অসংখ্য সৈনিকদের চরম জুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিলো। আল্লাহর সৈনিকদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে নির্যাতন করা হয়েছিলো। প্রায় ত্রিশ হাজার আলেমদেরকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো।

হজরত সায়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম মে রাতে বালাকোট পাহাড়ে তাঁর বাহিনী নিয়ে অবস্থান করেছিলেন। উক্ত এলাকায় এক বিশ্বাসঘাতক সম্প্রদায় ছিলো রাজা রনজিত সিং এর সহায়ক। তারা সি.আই.ডি. হয়ে গোপনে সংবাদ পৌঁছিয়ে দেয় রাজার নিকট। ফলে রাজার বাহিনী অপ্রস্তুত অবস্থায় রাত্রিতে সায়্যেদ আহমদ রহ. এর উপর আক্রমন চালায়। পাঁচ মে তাঁকে তাঁর ইবাদত গৃহে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় সেজদারত অবস্থায় শহীদ করে দেয়া হয়। ওইদিনই শাহ ইসমাইল শহীদ রহ. বাতিলের মোকাবেলার জন্য ময়দানে অবতরণ করেন। প্রচন্ড লড়াইয়ের পর তাঁকেও গর্দান দিতে হলো তরবারীর নিচে। একপর্যায়ে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে মাওলার দরবারে চলে যান তিনি।

এসব ঘটনা ইসলামী আন্দোলনের পথে অস্বাভাবিক কিছু নয়। একেবারেই স্বাভাবিক। ইতিহাসের পাতায় এমন অসংখ্য ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে যা আমাদের এগিয়ে যাবার তাগিদ দেয়।

দ্বীনের পথে জুলুম নির্যাতন সহ্য করা এবং সত্যের ওপর অটল থাকার ব্যাপারে আম্বিয়ায়ে কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম ও হক্কানি বুজুর্গদের জীবনের মধ্যে আমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। আর এ আদর্শ লালন করেই সকল বাঁধা উপেক্ষা করে আগামীর পথ চলতে হবে আমাদের। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।