আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ১২ ২০১৯, ০৪:৫০

আবদুল্লাহ আল মুকতাদির

ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে রোজার স্থান তৃতীয়।
বিশ্বের সব ধর্মের অনুসারীরা রোজা বা না খেয়ে থাকার মতো উপাসনা করে থাকেন । মুসলমানেরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় সিয়াম বা সাধনা, হিন্দু বা বৌদ্ধরা রোজা রাখলে বলা হয় উপবাস, খৃষ্টানেরা রোজা রাখলে বলা হয় ফাস্টিং, বিপ্লবীরা রোজা রাখলে বলা হয় অনশন। আর বিজ্ঞানীরা রোজা রাখলে বলে অটোফেজি।

Auto phagy শব্দটির সাথে বিজ্ঞানীরা পরিচিত খুব বেশি দিন না। এটি একটি গ্রিক শব্দ। Auto অর্থ নিজে এবং phagy অর্থ খাওয়া। শাব্দিক অর্থে autophagy মানে নিজে নিজেকে খাওয়া।

আমরা যে খাবার খাই। শরীরের এক ধরণের কোষ ওই খাবার খেয়ে থাকে। মানব দেহের ঐসব কোষ গুলো স্বাভাবিক খাবার না পেলে শরীরের অসুস্থ কোষ খাদ্য নালী ও পেটের মধ্যে জমে থাকা ময়লা আবর্জনা খাদ্যের উচ্ছিষ্ট অংশ ইত্যাদি খেতে শুরু করে। চিকিৎসা বিজ্ঞান এটাকে বলে অটোফেজি।

শুধুমাত্র এই auto phagy আবিস্কার করেই জাপানি ডাক্তার প্রফেসর ওশিনরি ওসুমি ২০১৬ সালে জিতে নেন নোবেল পুরস্কার। জানা যায় এরপর থেকে পশ্চিমারা ব্যাপকভাবে রোজা রাখতে শুরু করে। প্রফেসর ওশিনরি ওসুমি নিজেও নাকি সপ্তাহে দুদিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখেন।

আমাদের মাঝে প্রতি বছর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পয়গাম নিয়ে উপস্থিত হয় পবিত্র মাহে রমজান। উদ্দেশ্য আমরা যেন আমাদের মনের সকল লোভ-লালসা, কামনা, বাসনা, শঠতা, হিংসা, বিদ্বেষ পরিহার করে উন্নত চরিত্র অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি। সাথে সাথে দেহ-মনকে পুত ও পবিত্র, সুস্থ ও সবল রেখে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারি।

রোজা এমন একটি ইবাদত যা কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই রাখা হয়। তাই রোজা স্বভাবতই বান্দাকে আল্লাহর ধ্যান ও স্মরণের দিকে নিয়ে যায়। তাই রোজার অনুশীলন ব্যক্তির অন্তরে প্রশান্তি, তৃপ্তি এবং ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণের আশার এক অনুপম অনুভূতি সৃষ্টি করে। রোজার মাধ্যমে যেমনিভাবে পরলৌকিক সফলতা সাধন হয় তেমনিভাবে ইহলৌকিক উপকারীতাও প্রচুর৷ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজার উপকারিতা ও ক্ষতি কতটুকু তা নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন৷

মাহে রমজানুল মোবারক আসলেই অনেকে চিন্তায় পড়ে যান এই কারণে যে, রোজা রাখলে নাকি স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রোজায় কারো স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে বা রোজা রেখে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কোনও রোজাদারের মৃত্যু হয়েছে, এমন কোন ঘটনা ঘটেছে বলে অন্ততপক্ষে আমার জানা নেই। রমজান মাসের পরে দেখা যায় যে, যার যেরূপ স্বাস্থ্য ঠিক সেইরূপ আছে। এর পিছনে কারণও আছে। আসলে রোজার দিনে আমরা যে খুব একটা কম আহার করছি তা নয়, বরং কিছুটা ভালো ভালো এবং পুষ্টিকর খাদ্য আহার করি৷

প্রথমেই আমরা জেনে নেই রোজার উপকারীতা সম্পর্কে কোরআন কি বলে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন:
যদি তোমরা রোজা রাখো তবে তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ, তোমরা যদি সেটা উপলব্ধি করতে পারতে৷ (সূরা বাকারাহ-১৮৪)
এবার চলুন জেনে নেই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান রোজা সম্পর্কে কি বলে৷

একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনা তাঁর রোগীদের ৩ সপ্তাহের জন্য উপবাস পালনের নির্দেশ দিতেন। কারণ, বছরে ১ মাস রোজা রাখার কারণে মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গের বিশ্রাম ঘটে। সকল বিষয়ে বিশ্রাম অনিবার্য। মানুষের শরীরে এক প্রকার জৈব বিষ জমাট হয়। এই জৈববিষ দেহের স্নায়ু এবং অন্যান্য জীবকোষকে দুর্বল করে দেয়। এক মাসের রোজার ফলে এই জৈববিষ দূর হয়ে যায়। রোজা দেহের রক্ত প্রবাহকে পরিশোধন করে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপ্লোক্র্যাটন দু’ হাজার চারশ’ বছর আগে বলেছিলেন “খাদ্য তোমার রোগের ওষুধ”। অর্থাৎ খাদ্যকে আয়ত্ত করার মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ হতে মুক্তি পাওয়া যায়। আর এই আয়ত্ত করার অন্যতম মাধ্যম হলো রোজা।
শুধু তাই নয় বর্তমানে অনেক দুরারোগ্য রোগ যেমনঃ হৃদরোগ, চর্ম রোগ, বাত, কোষ্ঠকাঠিন্য, জ্বর, শ্বাসকষ্ট রোগ ইত্যাদি নিরাময়ে রোজা রাখার উপদেশ দেয়া হয়। রোজা এই সমস্ত রোগের কষ্ট দূর করে। রোজা রাখার ফলে শরীরের মধ্যস্থিত অনেক ক্ষতিকারক টক্সিনের বিষক্রিয়া থেকে শরীর রক্ষা পায়। এ অতি স্বাভাবিক ও অত্যন্ত কার্যকরী এই পন্থায় দেহাভ্যন্তরে বিধৌত ও পরিচ্ছন্ন হয়।

ইটালির বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী মাইকেল এংলো ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। ৯০ বছর বয়স পার হওয়া সত্ত্বেও তিনি কর্মক্ষম ও কর্মঠ ছিলেন। তাকে এর রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমি বহু দিন আগ থেকেই মাঝে মাঝে রোজা রেখে আসছি। আমি প্রত্যেক বছর এক মাস, প্রত্যেক মাসে এক সপ্তাহ রোজা রাখি এবং দিনে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা খাবার খাই।

মহাত্ম গান্ধীর উপোস থাকার ঘটনা সর্বজনবিদিত। ফিরোজ রাজ লিখিত দাস্তানে গান্ধীতে তিনি লিখেছেন। মহাত্ম গান্ধী রোজা রাখা পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন মানুষ খাবার খেয়ে নিজের দেহকে ভারী করে ফেলে। এরকম ভারী অলস দেহ দুনিয়ার কোনো কাজে আসে না। তাই তোমরা যদি তোমাদের দেহ কর্মঠ এবং সবল রাখতে চাও তবে দেহকে কম খাবার দাও। তোমরা মাঝে মাঝে সারাদিন উপস থাকো। আর সন্ধ্যায় বকরির দুধ দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করো। (দাস্তানে গান্ধী)

আলেকজান্ডার গ্রেট এবং এরিস্টল। উল্লিখিত দু’জনই ছিলেন অধিবাসী। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা বিশ্বখ্যাত। তারা মাঝে মাঝে ক্ষুধার্ত বা উপবাস থাকাকে দেহের সুস্থতা ও সবলতার জন্য খুবই উপকার বলে মনে করেন।

আলেকজান্ডার গ্রেট বলেন, আমার জীবনে অনেক ব্যতিক্রম ধর্মীয় অভিজ্ঞতা এবং ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, সকাল-সন্ধ্যা যে আহার করে সে রোগমুক্ত। আমি ভারতে প্রচণ্ড উষ্ণ এলাকা দেখেছি। সেখানে সবুজ গাছপালা পুরে গেছে। কিন্তু সেই তীব্র গরমের মধ্যেও আমি সকালে এবং বিকালে খেয়েছি। সারাদিন কোনো প্রকার পানাহার করিনি। এর ফলে আমি অনুভব করেছি এক নতুন অফুরন্ত প্রাণশক্তি৷
(আলেকজান্ডার গ্রেট)

ডাক্তার ক্লীভ তার পেপটিক আলসার নামক গবেষণামূলক পুস্তকে লিখেছেন- ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ নাইজেরিয়াতে অন্যসব এলাকার তুলনায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পেপটিক আলসার রোগের প্রকোপ অনেক কম। কেননা তারা সিয়াম পালন করে থাকেন। তাই তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘সিয়াম কোন রোগ সৃষ্টি করে না’।

ড. ডিউই বলেছেন, ‘রোগাক্লিষ্ট মানুষের পাকস্থলী থেকে খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না, উপবাস থাকছে তার শরীরে বাসা বেঁধে থাকা দীর্ঘদিনের রোগটি।’

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র প্রফেসর’স মোরপান্ড বলেছেন, আমি ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জানার চেষ্টা করেছি। রোজা অধ্যায় অধ্যয়নের সময় আমি খুবই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছি। চিন্তা করেছি ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য এক মহাফর্মুলা দিয়েছে। ইসলাম যদি তার অনুসারীদেও কোনো বিধান না দিয়ে শুধু রোজা দিত তবুও এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কিছু হত না।

বিষয়টি নিয়ে আমি একটু গভীর চিন্তায় মনোনিবেশ করলাম। তাই বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য আমি মুসলমানদের সাথে রোজা রাখতে শুরু করলাম। দেখলাম রোগ অনেকটাই কমে গেছে। আমি রোজা চালিয়ে গেলাম এতে দেহ আরো উন্নতি পরিবর্তন উপভোগ করলাম। কিছুদিন পর লক্ষ করলাম আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছি। এক মাস পর আমি নিজের মাঝে এক অসাধারণ পরিবর্তন অনুভব করলাম। (রসালানঈ দুনিয়া)

ইসলামে রোজা রাখার ব্যাপারে, কোথাও অতি ভোজনের উল্লেখ নাই। সব সময় পরিমিত ও পুষ্টিকর খাবারের কথা বলা হয়েছে। হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, পেটের তিনভাগের একভাগ খাবার, একভাগ পানীয় দিয়ে পূরণ করতে। অপর ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখতে বলেছেন। আর বর্তমান মেডিক্যাল সাইন্সও সেই কথাই বলে। রমজানে সারাদিন অভুক্ত থেকে কেউ কেউ অতিরিক্ত এবং বাজে খাবার খেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগান কিছু মানুষরূপী জ্ঞানপাপী শয়তান। আর একে কেন্দ্র করে রোজার ক্ষতিকারক দিকগুলো প্রচার করে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তারা। রমজান এলেই অনেক ক্ষেত্রে যে খাবারগুলো আমাদের দেশে তৈরি হয়, সেগুলো মোটেই স্বাস্থ্য সম্মত নয়। আর অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে যে কেউ অসুস্থ হবে সেটাই স্বাভাবিক। ঐ খাবারগুলো যদি রমজান মাস বাদে অন্য কোন মাসে খাওয়া হয় তাহলে ঐ ব্যক্তি অসুস্থ্ হবেই।

এ আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, রোজা ফ্যাট বা কোলেস্টেরল কমায়, এজিং প্রসেস ব্যাহত করে। শরীরের ডিটক্সিফিকেশন করে ও ইম্যুনিটি বৃদ্ধি করে, হজমতন্ত্রের এসিড নিঃসরণ কমায়, কিডনি স্টোন হওয়ার ঝুঁকি কমায়, নন ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবেটিস কমায়, হার্ট আর্টারি প্রেশার এবং লিভার আর্টারি প্রেশার কমায়। রোজা রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ থাকার অন্যতম উপায়।