আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ১৪ ২০১৯, ১১:২৮

১৪ ডিসেম্বর। শোকাবহ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী যখন দেখল তাদের চরম বিপর্যয় আসন্ন, তখনই তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যায়। বুদ্ধিজীবীদের ঘর থেকে চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। হত্যা করে তাদের লাশ ফেলে রাখে নিস্তব্ধ ভূতুড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন বধ্যভূমিতে। তাদেরকে চোখ বেঁধে হত্যা করে সেদিন পাকিস্তানীরা। একাত্তরের ডিসেম্বরের হেমন্তের স্নিগ্ধ এক সকালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিধনের দুঃখ ভারাক্রান্ত খবরটি সেদিন আসে। সেই থেকে জাতি দিনটি পালন করে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এসব বুদ্ধিজীবী মেধা, মনন ও লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। আর সেটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের জন্য। এসব কৃতী বুদ্ধিজীবীর তালিকা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র সংগঠন কুখ্যাত আলবদর ও আল শামস বাহিনী। পেছন থেকে মদদ যোগায় পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী। ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত সে তালিকা ধরে ধরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্যতম অপকর্মটি করে এই ঘাতক চক্র। সান্ধ্য আইনের মধ্যে রাতের আঁধারে তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে চোখ বেঁধে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিজয় অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে রায়েরবাজার, মিরপুরসহ কয়েক জায়গায় পাওয়া যায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষত-বিক্ষত বিকৃত লাশ।

কিন্তু ফিনিক্স পাখির আয়ু নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বারবার ফিরে ফিরে আসেন বাঙালীর মানসপটে। প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে প্রতিভাত হয় কবির সেই অমিয়বাণী ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ এমনি শোকের আবহ আর শক্তির তেজ নিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারো যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশ ও প্রবাসে পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন ঘাতকদের হত্যাযজ্ঞের টার্গেট। ২৫ মার্চের কালরাতে এবং পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ চলাকালে সুপরিকল্পিত উপায়ে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে হত্যা করা হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের। কারণ দেশ ও জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানরা ছিলেন সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের প্রতীক। পাকিস্তানী শাসক-শোষক চক্রের অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তারা ছিলেন দিকনির্দেশক এবং সোচ্চারকণ্ঠ। তাদের মেধা ও মননে অসা¤প্রদায়িকতা ও মানবিক মূল্যবোধ ছিল গভীরভাবে প্রোথিত। এই বোধ তারা ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে। তারা স্বপ্ন দেখতেন সুস্থ-সুন্দর সমাজের। একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও শোষণমুক্ত প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাংক্ষা তারা লালন করতেন তাদের কর্মে ও চিন্তায়। তাই এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা পরিণত হয়েছিলেন স্বাধীনতার শত্রুদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে।

দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর বাংলাদেশের মানুষ যখন জাতীয় স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত তখনই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তনী সেনাবাহিনী বর্বর উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালী জাতির ওপর। সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে তারা শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা। এরই প্রেক্ষাপটে বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে যেখানে পায় আক্রমণ করতে থাকে। এভাবেই কেটে যায় দীর্ঘ ৯টি মাস।

জাতির এইসব উজ্জ্বল নক্ষত্র হত্যার মাধ্যমে হানাদাররা আমাদের মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল লড়াকু বাঙালী জাতি স্বাধীনতা অর্জন করলেও যেন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পংগু, দুর্বল ও দিক-নির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে। মেধা ও নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়লে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, এমন নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই হায়েনারা বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল।

ডিসেম্বর মাসে এসে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী। মুক্তিসেনারা ঘিরে ফেলে রাজধানী ঢাকাকে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যার নির্মম খেলায়। দখলদার পাকিস্তনীরা মনে করেছিল যারা এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির মননশক্তি- তাদের হত্যা করতে পারলে বাঙালী জাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব হবে। ফলে ৯ মাসের যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে পাকিস্তানী বাহিনীর দোসররা ঢাকায় মেধাবী ও সাহসী শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের রাতের আঁধারে তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে একে একে ধরে এনে হত্যা করে। ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্নসহ তাদের অনেকের লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে।

সেদিন শহীদ হন যাঁরা: একাত্তর সালের ডিসেম্বরে ঢাকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী ও পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা আর বিভিন্ন পেশার কৃতী সন্তানদের অপহরণ করে পাকিস্তীিন সৈন্যরা নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। পরে ঢাকার মিরপুরের ডোবা-নালা ও রায়েরবাজার ইটভাটায় বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায় বুলেটবিদ্ধ তাদের নিথর শরীর। তাদের হাত ছিল পেছনে বাঁধা, ক্ষতচিহ্ন ছিল শরীরজুড়ে। এ নিধনযজ্ঞে জাতি হারায় তার অসংখ্য মেধাবী সন্তানকে। একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।

তবে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে, সে অনুযায়ী ৯৯১ শিক্ষাবীদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলীকে সেদিন হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন জিসি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহিদুল্লাহ কায়সার, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমদ, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, আরপি সাহা, আবুল খায়ের, রশিদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহী, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সায়ীদুল হাসান, হাবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীন প্রমুখ।