অবশেষে না ফেরার দেশে সাদেক হোসেন খোকা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

নভেম্বর ০৪ ২০১৯, ২০:৫০

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পরিকল্পনা করলো তারা সারাবিশ্বে প্রচার করবে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের নির্বাচিত সরকারই দেশ পরিচালনা করছে। এই উদ্দেশ্যে তারা উপ-নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলো। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা দল চিন্তা করলো তারা পূর্ব পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের মূল কার্যালয়ে অপারেশন চালাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ১৯ বছরের এক তরুণ যোদ্ধা অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে রাজারবাগের উল্টোদিকে মোমিনবাগে অবস্থিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের হেড অফিসটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিল। নির্বাচন কমিশন উড়িয়ে দেওয়ার খবরটি বিবিসি, সিএনএন এর মত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে টানা দুইদিন ধরে প্রচার করা হয়েছিল।

একাত্তরের রমজান মাসে পাকিস্তানিরা পরিকল্পনা করলো তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার করবে পূর্ব পাকিস্তান শান্ত, পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। তাই তারা মানুষজন ভাড়া করে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে শ্যুটিং করা শুরু করলো। দেখানো হচ্ছে — ঈদকে সামনে রেখে বাজারে ব্যাপক ভীড়, প্রচুর কেনাকাটা চলছে। গেরিলা যোদ্ধাদের ওই দলটি খোঁজ নিয়ে দেখলো সরকারের ফিল্ম ডিপার্টমেন্ট থেকে এই কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। উনিশ বছরের ওই তরুণ কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে দিনে দুপুর ঢাকা শহরের ব্যস্ত এলাকায় অবস্থিত ফিল্ম ডিপার্টমেন্টের অফিসে অপারেশন চালিয়ে অফিসটি লণ্ডভণ্ড করে দেন। পাকিস্তানিদের শ্যুটিং কার্যক্রম বরবাদ হয়ে যায়।

শহীদুল্লাহ হলের পেছনে ছিল এয়ার ফোর্সের রিক্রুটিং অফিস। পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ওই ভবনটি। মাত্র তিনজন সঙ্গী নিয়ে ট্যাক্সিতে করে এসে উনিশ বছরের ওই তরুণ বিস্ফোরক দিয়ে ভবনটি উড়িয়ে দেন। যুদ্ধের পরে জায়গাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়, বর্তমানে সেখানে শহীদুল্লাহ হলের এক্সটেনশন বিল্ডিং।

১৯৭১ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত উনিশ বছরের যে তরুণটির কথা বলছি তার নাম সাদেক হোসেন খোকা। তিনি ১৯৫২ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দেশের কথা ভেবে মা আর মাটি কে মুক্ত করার জন্য পরিবারের অন্য কাউকে কিছু না জানিয়েই গোপনে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। মেঘালয়ের ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষে ঢাকায় অপারেশনের ফাঁকে গোপনে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি।

সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত যেসব স্লোগান জনপ্রিয় হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল, ১৯৭১ এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা রুহুল আমীন এবং গোপীবাগের মাসুদসহ (বুড়া) বেশ কয়েকজন মিলে প্রথমে যান নরসিংদীর শিবপুরে। ওখানে কয়েক দিন অবস্থানের পর যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য আগরতলার পৌঁছলে তাদের রিসিভ করেন শহীদুল্লাহ খান বাদল (রাশেদ খান মেননের ছোট ভাই)। সেখান থেকে প্রথমে বটতলায় সিপিএম অফিসে গিয়ে মেনন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে চলে যান দুই নম্বর সেক্টরে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেই সেক্টরের কমান্ডার। মেজর হায়দারের (পরে কর্নেল হায়দার) নেতৃত্বে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

দুই নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নাম ছিল ‘মেলাঘর’। মেলাঘরের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বসবাসের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। পাহাড় আর ঘনজঙ্গলে পূর্ণ ছিল চারদিক। লালমাটির উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ একটু বৃষ্টি হলেই বেশ পিচ্ছিল হয়ে যেত। সৌচকর্ম সারতে যেতে হতো বনের ভেতর। এ ক্যাম্পে বেশিরভাগই ছিল ঢাকা শহরের ছেলে, এ রকম পরিবেশে থাকতে তারা অভ্যস্ত ছিল না। তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মরহুম মেসবাহ উদ্দিন সাবু একসঙ্গে থাকতেন।

এ ক্যাম্পেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় আবু সাইদ খান, শাহাদত চৌধুরী, ফতেহ আলী চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সুলতান উদ্দিন রাজা, আতিকুল্লাহ খান মাসুদ, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, পল্টনের মানিক (পরে শহীদ), গাজী গোলাম দস্তগীর, মিজান উদ্দিন আহমেদ, শহীদুল্লাহ, শিল্পী শাহাবুদ্দিন, মাসুদ, কাজী ভাই, উলফাৎ ও বাকী (পরে শহীদ) অন্যতম। মেজর হায়দারের অধীনে তিন সপ্তাহ গেরিলা ট্রেনিং শেষে তারা সম্মুখযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন গাফফারের (পরে জাতীয় পার্টি নেতা ও মন্ত্রী) নেতৃত্বাধীন সাব-সেক্টরে। ওখানে ট্রেনিং শেষ করার পর প্রথমদিকে কসবা-মন্দভাগ (মির্জাপুর) যুদ্ধের নয় মাসই প্রতিদিন এক বা একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ স্বাধীন পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে বামপন্থী ( ন্যাপ) রাজনীতি ছেড়ে বিএনপি তে নাম লেখান। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসনে( সূত্রাপুর কোতোয়ালি) থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় উঠে আসেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ও তিনি বিজয়ী হন। তিনি ২০০২ সালের ২৫, এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটির মেয়র নির্বাচিত হন এবং ২৯, নভেম্বর ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর তিনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা মহানগরের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন।

অবশেষে তার বর্ণাঢ্য জীবনের জয় পরাজয় ঘাত প্রতিঘাত সব কিছুর ঊর্ধ্বে এসে সাদেক হোসেন খোকা ৪ নভেম্বর ২০১৯ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। উল্লেখ্য যে ২০১৪ সালের ১৪ মে তিনি চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। এবং মৃত্যুকালে তিনি তার স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়ে সহ বহু শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে যান। পরিশেষে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

 

খোরশেদ আলম বিপ্লব।
লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।
একুশে জার্নাল
ঢাকা,বাংলাদেশ।
৪, নভেম্বর ২০১৯