অনন্য বৈশিষ্ট্যের বিরল ব্যক্তিত্ব শায়খুল হাদীস আল্লামা শিহাবুদ্দীন রহ.

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ০৯ ২০১৯, ০০:২৯

আহমদ কবীর খলীল
হাদীসের খেদমতে যারা নিজেদের জীবন ওয়াক্বফ করে দেন, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তাঁর খলীফা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেছেন, আল্লাহর দরবারে তাদের চেহারার ঔজ্জল্যতা কামনা করেছেন। শায়খুল হাদীসে আল্লামা শিহাবুদ্দীন (রেঙ্গার মুহাদ্দিস সাহেব) রহ. তাঁর জীবনকে হাদীসের খেদমতের জন্য ওয়াক্বফ করে রেখে ছিলেন। কর্মজীবনের সূচনা থেকে দ্বীর্ঘ বায়ান্নটি বছর যিনি একই মাদ্রাসায় ( তথা সিলেটের বৃহত্তম ইসলামী বিদ্যাপীঠ জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায়) শায়খুল হাদীসের আসনে থেকে নিরলস ভাবে হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, এটা কোনো চাট্টিখানি কথা নয়। এত দীর্ঘকাল হাদীসের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া কেমল তাদের পক্ষেই সম্ভব যাদেরকে আল্লাহ পাক মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেলাফতের জন্য কবুল করে থাকেন। হাদিসের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার কারণে আল্লাহ পাক সবার কাছে তাঁর পরিচয় “মুহাদ্দিস সাহেব” হিসেবে এত ব্যাপক করে দিয়ে ছিলেন যে, এখন অনেকেই তাঁর নাম বল্লে হয়তো চিনবেনা, কিন্তু রেঙ্গার মুহাদ্দিস সাহেব বল্লে চিনতে কোনো অসুবিধা হবেনা।

যারা এই মহান মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরের দরসে বসার সৌভাগ্য লাভ করেছেন, তারা অবশ্যই লক্ষ করেছেন, হুজুর বুখারী শরীফের কিভাবে অনর্গল হাদীস গুলো পেশ করে তার ব্যাখ্যা উপস্হাপন করতেন, মনে হতো যেন হাদীসের শরাহ-শরুহাত বিশেষ করে বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্হগুলো হুজুরের চোখের সামনে! হুজুরের ছাত্ররা কিছু হলেও অনুমান করতে পেরেছেন যে, হাদীসের জগতে এ কনজন্মা মুহাদ্দিসের অবস্থান কত গভীরে ছিলো! তাঁর ছাত্র, সহকর্মী, সমসাময়িক আলেম-উলামা এমনকি উস্তাদগণও তাঁর ইলম ও আমলের প্রশংসায় এমন ভাবে পঞ্চমুখ থাকতে দেখা যায় যে, যার দ্বারা তাঁর ব্যাক্তিত্বের মহানত্ব ও ইলমের গভীরত্ব সহজেই পরিমেয় হয়ে ওঠে। আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী, আল্লামা নুরুদ্দিন গহরপুরী, আল্লামা শায়খে কৌড়িয়া রাহি. সহ আকাবিরদের অনেকেই তাঁর ইলম সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করতেন। আমিই তখনও তাকে দেখিনি, সেই শৈশব থেকে তাঁর ইলমের প্রশংসা আমার মুহতারাম আব্বার জবান থেকে শুনে আসছি এবং তখন থেকেই তাঁর কাছে হাদীস পড়ার স্বপ্ন অন্তরে রোপিত রেখেছিলাম এবং আল্লাহর অশেষ দয়ায় অবশেষে তাঁর কাছে হাদীস পড়ার সৌভাগ্য হয়। তাঁর দ্বীর্ঘ দিনের সহকর্মী, জামেয়া রেঙ্গার সাবেক মুহাদ্দিস, আমার আব্বা শায়খুল হাদীস মাওলানা আবদুল মালিক সমশেরনগরী ( /রুপসপুরী) প্রায়ই বলতেন ; রেঙ্গার মুহাদ্দিস সাহেব হলেন “ইলমের সাগর”! উলামায়ে কেরামের ভরা মজলিশে এভাবে তাকে বারবার বলতে শুনেছি। তিনি আরো বলেন ; তিনি রেঙ্গায় থাকার প্রাথমিক সময়ে প্রায়ই আসাতিয়ে কেরামের মধ্যে ইলমি মোবাহাসা ( বিষয় ভিত্তিক বিতর্ক) হতো, তখন হাদীস পেশ করে দলীল উপস্হাপনের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরের সামনে কেউ টিকতে পারতেন না, এমনকি তিনি একা এবং সবাই একদিকে হলেও তাঁর সাথে কেউ পারতেন না! তিনি আরো বলেন ; রেঙ্গার মুহাদ্দিস সাহেব রহ. যেমন ছিলেন দারসের ময়দানে অনেকবড় শায়খুল হাদীস, ওয়াজের ময়দানেও ছিলেন অনেকবড় ওয়ায়িজ। তিনি যেমন বাহ্যিক সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন, ছিলেন সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী, তেমনি তাঁর ভিতরও স্বচ্ছ,সুন্দর এবং এখলাস, লিল্লাহিয়্যত এবং আল্লাহপাক ও তাঁর রাসুলের ভালবাসায় ভরপুর।
একজন মুহাদ্দিসের ইলমেরপ্রশংসা আরেকজন মুহাদ্দিসের পক্ষ থেকে হলে তা কত নিশ্চিত ভাবে গ্রহণীয় হতে পারে, তা অবশ্যই বলার অপেক্ষা রাখেনা।
হুজুরের আরেক সহকর্মী জামেয়া রেঙ্গার স্বনামধন্য শিক্ষাসচিব, আল্লামা মুফতি গোলাম মোস্তফা সাহেব দা.বা. সর্বদা মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরকে উস্তাদের মত সম্মান করতে দেখেছি। তিনিকে প্রায়ই বলতে শুনেছি ; মুহাদ্দিস সাহেব হুজুর কত জীআখলাক্ব ( উন্নত চরিত্রের অধিকারী) এবং কত ইলমওয়ালা! তা কিভাবে বুঝাবো! সুবহানাল্লাহ!!

আমাদের প্রাণপ্রিয় মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরের ইলম ও আমলের ব্যাপারে তাঁর উস্তাদ থেকে নিয়ে শাগরেদ এবং সহকর্মী কারো কোনো ক্বীল ও ক্বাল ( কথা) ছিলো না এবং থাকতেও পারে না। যেকারণে হযরত শায়খে রেঙ্গা রহ. থেকে নিয়ে জামেয়ার অতীত বর্তমানের সকল মুরব্বি ও আসাতিযায়ে কেরাম সবাই হুজুরকে মুহাব্বাত এবং শ্রদ্দার নজরে দেখতেন। হুজুরের ছাত্ররা হুজুরকে কত ভালবাসতো,কত শ্রদ্ধা করতো তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দ্বীর্ঘ বায়ান্ন বছরের ইতিহাসে হুজুরের প্রতি কেউ অশ্রদ্ধা দেখিয়েছে, এমন কোনো নযীর নেই। এমনকি যে এলাকায় জীবনের এই দ্বীর্ঘকাল তিনি কাটিয়েছেন সেই এলাকার সর্বসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন
পরম শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালবাসার পাত্র।
আহ! কিভাবে যে বলি! আমাদের দাওরায়ে হাদীসের বৎসর হুজুর রহ. যখন দরসে আসতেন, আমাদের আনন্দের কোনো শেষ থাকতো না। বৎসরের শেষ দিকে বুখারী শরীফের দরসে কখনও রাত বারোটা – একটা হয়ে যেতো, কিন্তু কখনো আমাদের বিরক্তি আসতো না, বরং মনে চাইতো সারা রাত যেনো আমাদের সামনে তিনি দরস দিতে থাকুন আমরা হুজুরের চেহারার পানে থাকিয়ে থেকে হুজুরের মোবারক জবান দিয়ে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুমধুর বাণীগুলো শুনতে থাকি। আহ! কি আনন্দঘন ছিলো সেই মুহূর্তগুলো! কি ভালবাসাময় ছিলো সেই সময়-ক্ষণ, যখন আমাদের শায়খের জবান থেকে ক্বালা হাদ্দাসানা – ক্বালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুমধুর বাণী উচ্চারিত হতো আর তাঁর চেহারার পানে থাকিয়ে দেখতাম ; নবীজীর ভালবাসায় অশ্রু টলমল করছে! আহা! কত শায়খদেরকে দেখি এবং শুনি, তারা অবশ্যই স্বস্থানে স্বমহিয়ান তবে আমাদের শায়খ ছিলেন আমাদের কাছে অদ্বিতীয়! জীবনে কখনো আমাদের এই মহান শায়খকে ভুলে যাওয়া কোনো শাগরেদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না জানিনা!

প্রিয়পাঠক, আমাদের শায়খুল হাদীস আল্লামা শিহাবুদ্দীন রহ.- এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা দেয়ার যোগ্যতা আমার নেই, তথাপিও সর্বসাধারণের শিক্ষাগ্রহণের সুবিধার্থে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিম্নে পেশ করার চেষ্টা করলাম।
তিনি এত বড় আলেম, হাজার হাজার মুহাদ্দিস মুফাসসির ও উলামায়ে কেরামের উস্তাদ, হাজার হাজার মুসলিম জনতার পীরওমুরশিদ, সর্বমহলে সমাদৃত ও শ্রদ্ধাভাজন এবং সুনাম সুখ্যাতির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও একেবারে সাধারন বেস ভূ সায় চলতেন। নিরহংকার ও নম্রতার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে তাঁর নযীর মিলানো সত্যিই দুস্কর।

প্রচার বিমুখতা ছিলো তাঁর স্বভাব। তিনি এতসব ঙান-গরিমা, কর্মতৎপরতা এবং উচু অবস্থান ওয়ালা হওয়া সত্বেও নিজেকে লুকায়িত রাখার চেষ্টা করতেন। যে কর্মকৌশল কিংবা ভাব-ভঙ্গিমায় মানুষ নিজেকে সমাজে উপস্হাপন করার চেষ্টা করে, তাকে সর্বদা এত্থেকে দূরে থাকতে দেখা যায়।

নিজের দায়িত্ব ও কর্মে ছিলেন সর্বদা একনিষ্ঠ ও সক্রিয়। তিনি কোনো দায়িত্ব নিজেত্থেকে চেয়ে নেয়া তো দূরের কথা, দায়িত্ব ও পদাধিকারের কোনো লালসাই তাঁর মধ্যে কোনো ভাবেই প্রকাশ পায়নি। এতদসত্ত্বেও কোনো দ্বীনি দায়িত্ব তাঁর উপর চলে আসলে তিনি সর্বোচ্ছ সক্রিয়তা ও আন্তরিকতার সাথে তা আঞ্জাম দিয়ে যেতেন। আজাদ দ্বীনি এদারায়ে তালীম বাংলাদেশের তিনি আমরণ নাজিমে ইমতেহান ( পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক) ছিলেন। শেষ সময়ে এসে কঠিন অসুস্হতা নিয়েও সক্রিয় ভাবে কাজ আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।
তিনি পরনির্ভরতা ও মুখাপেক্ষীতাকে অপছন্দ করতেন। কোনো বিষয়ে কারো মুখাপেক্ষী হওয়া কিংবা কারো কাছে ধর্না দেওয়া ছিলো তার স্বভাব বিরোধী। তিনি একমাত্র আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয়ে তার কাছথেকেই সব কিছু চেয়ে নেয়াকে ভালবাসতেন। কোনো মানুষের কাছে তিনি কিছু সওয়াল করেছেন কিংবা সওয়ালের ভান করেছেন, এরকম কখনো শুনা যায়নি।

নিজের কাজ নিজে করা,এটা ছিলো তাঁর অভ্যাস।

এই বৃদ্ধ বয়সে এবং অসুস্থতার সময়েও তাকে নিজের কাজ নিজে করতে দেখা যেতো। তাঁর কাপড়-ছোপর তিনি নিজ হাতেই ধুঁয়ার চেষ্টা করতেন। অথচ, তাঁর ছাত্ররা তাঁর কাপড়-ছোপর ধূয়ে দিতে পারাকে সৌভাগ্যের বিষয় মনে করতো এবং সর্বদা সুযোগের আশায় থাকতো।
উস্তাদদের প্রতি মুহাব্বাত ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধার ক্ষেত্রেও তাঁর ছিলো স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর হাদীসের উস্তাদ শায়খুল ইসলাম, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তি ও তাঁর প্রতি উনার স্নেহ-ভালবাসা এবং প্রশংসা বাণী দেখে ও শুনে আমরা বারবার আবিভূত হয়েছি। শায়খুততাফসীর আল্লামা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রহ.- এর প্রতি হুজুরের ছিলো গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। শায়খে রেঙ্গার কথা রক্ষা করতেই হুজুরের অসুস্থতা সত্বেও আজীবন রেঙ্গা মাদ্রাসায় অতিবাহিত করেন। কারণ, শায়খে রেঙ্গার তামান্না ও নির্দেশ ছিলো হুজুর যেনো মৃত্যু পর্যন্ত জামেয়া রেঙ্গায় থাকেন এবং অবিভাবকত্ব করেন। শায়খের নির্দেশকে তিনি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেছেন।

তিনি কথা খুব কম বলতেন। সূরগুল করা ছিলো তাঁর স্বভাব বিরোধী। অন্যের আলোচনা ও পরনিন্দা করা তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না।
ছাত্রদের প্রতি ছিলো তাঁর গভীর ভালবাসা ও দরদী মনোভাব। আবার ছাত্রদের লাগামহীন চলাফেরা করতে দেখলে তিনি খুবই গোস্বা করতেন। কারো সাথে তর্কে জড়ানোকে তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না। তাঁর বয়ানগুলো ছিলো সর্বদা কুরআন-সুন্নায় ভরপুর ও ইতিবাচক ভঙ্গিতে। তিনি সর্বদা মুচকি হাসতেন, কখনো তাকে অট্রহাসি দিতে দেখা যায়নি। রাস্তা দিয়ে খুব শান্ত ও নম্র ভঙ্গিতে হাটতেন। দুনিয়াবী লোভ-লালসা তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। খুবই গম্ভীর হওয়া সত্বেও মাঝে মধ্যে রসিকতা করতেন। তিনি মাসওয়ারায় বসলে খুবই চিন্তা করে মতামত দিতেন। এভাবে অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আমাদের প্রানপ্রিয় মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরের গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে শেষ করা কিভাবে সম্ভব!
মহান এই বুযুর্গ গত ২৬ শে রমজান ১৪৪০ হিজরী,রোজ শনিবার , নিজের এলাকার মসজিদে তারাবীর নামাজ শেষে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপুর্ণ নসীহত করেন, অতপর বাড়িতে পৌঁছার পর মধ্য রাতে নুযুলে রাহমাতের সময় ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ও ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আল্লাহ পাক যেনো তাঁর কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দেন এবং আমাদেরকে নি’মাল বদল দান করেন। আমীন।

শিক্ষক, জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা, সিলেট।