অচেনা থেকে চেনা তারপর হৃদয়ে!

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ১৯ ২০২১, ২২:৩৮

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন


দিনটি মনে নেই। ঘটনাটি মনে আছে। খতমে নবুওয়তের আন্দোলন চলছে তখন। আন্দোলন চলছে কুখ্যাত সালমান রুশদীর বিরুদ্ধেও। দেশের বরেন্য উলামা-মাশায়েখের কাংখিত আগমনে প্রানবন্ত সদা মাদ্রাসার নিবিড় পরিবেশ। ফরিদাবাদ মাদরাসার কথা বলছি! ক্লাশ-শেষে আঙ্গিনায় নামি আমরা। প্রতিদিন হাটি ও ক্লান্তি দূর করি । সে দিনও বেরোলাম। একবন্ধুর উষ্ণ খোঁচায় চকিত হলাম। আর শোনলাম-কাসেমী যায়-কাসেমী যায়-
জিজ্ঞেস করে চিনলাম তাকে। গভীরভাবে দেখলাম কিছুক্ষণ। তার অবয়বে দৃষ্টি বচনে অনুমিত হল চঞ্চলতা স্পৃহা আর সংগ্রামের অনির্বান চেতনা; কিন্তু কাসেমী’ নামের আদিগন্ত আমার জানা নেই। তাই রাতের বেলা জঞ্জাল বাঁধালাম মাওলানা বশীর উদ্দীন সাহেবের দরবারে । তৎকালীন ফরিদাবাদের এক দরিয়া দিল মুহাদ্দিস তিনি। সকল ছাত্রের জন্যে তার হৃদয়ে সমান জায়গা ছিল । তার কাছে যে কোন ছাত্র নির্দ্বিধায় বলতে পারত মনের কথা-কামনার কথা। তিনি তখন থেকেই আমার অভিভাবক। তাই যে কোন বিষয়ে প্রশ্ন জাগলেই তাকে আমি জ্বালাতাম-জ্বালাই এখনো।

অভ্যাস মাফিক ঢুকে পড়লাম কক্ষে। তিনি লিখছেন। লেখা-লেখি তার পেশা। আমাকে দেখেই এক চিমটি হাসলেন। বললেন, কি ব্যাপার? বললাম, ব্যাপার বড়। নড়েচড়ে বসলেন তিনি। যেন যে কোন কঠিন স্রোত সামলাতে প্রস্তুত হলেন। বললাম, শামসুদ্দীন কাসেমী সাহেব কে? উনাকে কাসেমী বলা হয় কেন? একেবারে কাঁচা খোকার প্রশ্ন! আনাড়ী প্রশ্ন!!

মুহুর্তে বদলে গেলেন তিনি; তার স্বভাবজাত হাস্যরস যেন কেটে গেল মুহূর্তে। সেস্থানে সগর্বে জায়গা করে নিল গাম্ভীর্য। মনে হল, তিনি আবেগে-আনন্দে বেদনায় যেন আন্দোলিত হচ্ছেন-স্পন্দিত হচ্ছেন। অতঃপর বলতে লাগলেন-

মাওলানা কাসেমী একজন স্বার্থক কাসেমী। হ্যাঁ, ইংরেজ ভলুকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন যে মহামনীষী, সশস্ত্র বিপ্লব সাধ্যাতীত সময়ে ইংরেজ সভ্যতার রক্ত-মজ্জায় বিরোধী মুজাহিদ তৈরীর দুর্বার স্বপ্ন নিয়ে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে অমর পুরুষ তিনিই মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহঃ)। তাঁর যাঁরা ভাবশিষ্য, তাঁর দর্শন-বিশ্বাস যাদের পথ ও মত; সেই ঐতিহ্যবাহী দারুল উলুম থেকে সেই চিরন্তন মনীষার চেতনা নিয়ে যারা পাঠোত্তীর্ন হয় তারাই কাসেমী । মাওলানা কাসেমী তাঁদেরই অন্যতম একজন।

তিনি আরো বললেনঃ মাওলানা নানুতবীর আদর্শের মাপকাঠিতে কাসেমীর তুলনা মেলা ভার। চিন্তা-চেতনা প্রতিষ্ঠায় তিনি এক আদর্শ শিক্ষক। যেমনটি ছিলেন হযরত নানুতবী (রহঃ)। অন্যায়ের প্রতিবাদে আপোষহীন যোদ্ধা। কর্মজীবনের শুরু থেকেই তিনি খতমে নবুওয়ত সংগ্রামের দুর্বীনিত কর্মী। নবীজীর দ্বীনের জন্যে হযরত নানুতবী (রহঃ) ইংরেজদের রোষানলে পড়েছিলেন, সেই একই দাবীতে মাওলানা কাসেমী এই বাংলাদেশে জেল-হাজত খেটেছেন।

বহুঘাত প্রতিঘাত সয়েছেন জীবনে। কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হননি। অজানা স্রোতে ভেসে গেছে অনেক সহকর্মী । কাসেমী আছেন নিজের জায়গায়। সুযোগের আশীর্বাদে ধনকুবের হয়েছেন কত নেতা অথচ কাসেমী ছাড়েনি কাসেমের (নানুতবীর) পথ! আজ এদেশে খতমে নবুওয়ত শব্দটি উচ্চারণ করলেই স্মৃতিতে ভাসে কাসেমীর নাম । একজন মুমিনের জীবনে এরচে বড় সফলতা আর কি হতে পারে? তাঁর নবীর নামের বিপ্লব যেন তার নামের অংশ অখন্ড পরিচয় তার!

আমার পরম শ্রদ্ধেয় হুজুর থামলেন। আমি এবার বিনীতভাবে প্রশ্ন করলাম, এর লেখা বইয়ে, খান-কাসেমী’ নামে যে সমালোচনা করা হয়েছে, তিনি কি এই কাসেমী?

এবার হুজুর হাসলেন। হাসিতে ব্যথার উচ্চারণ ছিল। গন্ধছিল কলেজা ছেচা! হালকা স্বরে বলতে লাগলেনঃ কাসেমী সাহেবের একটি বৈশিষ্ট্য আছে। বিরল বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য তাঁকে সমকালীন অনেকের মাঝে আলাদা করে রেখেছে। আমি মনে করি, অনন্ত কাল এ একটি বৈশিষ্ট্যের কারণে মাওলানা কাসেমী এক বিরল, স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরাজ করবেন এদশে, এদেশের ইসলামী সংগ্রামের বাতাসে-বাতাসে, চিন্তা-চেতনার পাতায় পাতায়। আর তা হলো আপোষহীনতা।

এদেশে ইসলামের নামে আন্দোলনের বাজার এখন তুঙ্গে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এদেশেএমন অনেক মহারথী আছেন, যারা দ্বীন-ধর্মের বারোটা বাজাচ্ছেন-আর মঞ্চে দাবড়াচ্ছোন দ্বীন-ধর্মের ঘোড়া। মওদূদী-শিয়াদের গোপন চেতনায় তারা বেসামাল হয়ে আন্দোলনের বন্যা বইয়ে দিতে চালাচ্ছেন। তাক লাগানো আন্দোলন! বিশ্বব্যাপী আন্দোলন! ঐক্যের আন্দোলন! তাওহীদ বাদী আন্দোলন। যেখানে দলাদলির ফারাক থাকবেনা। ইসলামী বিপ্লবের পথে চিরন্তন বাধা মওদূদী-শিয়াবাধাও না। সকল তাওহীদবাদী ভাই ভাই। আকীদা-বিশ্বাসের জটিল বিতর্কিত বিষয়গুলো এখন বিবেচ্য নয় তাদের কাছে। ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হলে ঠান্ডা মাথায় ও সব ঘাটাঘাটি করা যাবে।

কিন্তু কাসেমী বলেনঃ না, এমন হতে দেয়া যায় না। নবীকে যারা বিশোদগার করে, সাহাবীদের প্রতি যাদের ঘৃনিত আক্রোশ, মুসলিম উম্মাহর হাজার বছর ধরে লালিত আকীদা-বিশ্বাসে যাদের অনাস্থা, কুরআন-সুন্নাহর দর্শনের প্রতি যাদের অবজ্ঞা। প্রগতিবাদী এসব নব্য ইসলাম দুশমনের সাথে কোন আপোষ হতে পারে না। বরং পহেলা বিপ্লব তো হবে এদের বিরুদ্ধেই

কাসেমী সাহেব মনে করেন, দলের বা দেশের নামের সাথে ইসলাম’ যোগ হলেই তা ইসলামী হয় না। কালো মানুষের নাম যেভাবে লাল মিয়া কিংবা সুন্দর আলী রাখলেই সে সুশ্রী হয়না। মদের দোকানের নাম যেমন ইসলামিয়া মদ্যশালা রাখলেই মদ হালাল হয়না- ঠিক সেভাবেই। মূলতঃ চেতনা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এই আপোষহীন মনোভাবের কারণেই কতিপয় কথিত বিপ্লবী, ইসলামী (?) ব্যক্তিত্ব কাসেমীর প্রতি কাদা ছুড়ছেন। কিন্তু একদিন এই কাঁদা বুমেরাং হয়ে তাদেরকেই কলংকিত করবে। আপনারা বেঁচে থাকলে দেখবেন।

সে দিন কিছুই বলতে পারিনি। আজকে বলছি, হ্যা, দেখছি। সেই দিনের সেই নন্দিত বিপ্লবীদের নিন্দিত জীবন নিয়মিতই দেখছি। কলংক ও দেখছি। সে দিন মাওলানা কাসেমীর ব্যক্তিত্বের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এবং এই ভাবে।

তারপর সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে কাসেমী সাহেব সম্পর্কে অনেক শুনেছি, অনেক জেনেছি। আর দেখেছি এমন যেমনটি শুনেছি পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মাওলানা বশীর উদ্দীন সাহেবের কাছে। আমি কাসেমী সাহেব কে খতমে নবুওয়তের দাবীতে কথা বলতে দেখেছি। মঞ্চে ময়দানে ইসলামী সংস্কৃতির কথা বলতে শুনেছি। আমি দেখেছি, প্রিয় নবীজীর (সাঃ) শানে গোলাম কাদিয়ানীর মিথ্যাচার আর এ বিষয়ে সরকারের অবাঞ্ছিত শৈথিল্য সম্পর্কে যখন কথা বলতেন, তখন তিনি রীতিমত কাঁপতেন। তিনি কাঁপতেন প্রিয় রাসূল (সাঃ) এর ভালোবাসা, নবী দুশমনদের প্রতি তরঙ্গায়িত রোষে সীমাহীন ক্রোধে আর ঈমানের তীব্র উষ্ণতায়। প্রিয় রাসূলের চিরন্তন দুশমন গোলাম কাদিয়ানীর কথা যখন তিনি বলতেন, মনে হতো, বার্ধক্যের অমোঘ গন্ডি অতিক্রম করে-ফেলে আসা যৌবনে ফিরে গেছেন তিনি। মনে হতো, বাক যুদ্ধে নয় সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন। ঐ সামনেই বুঝি মককার আবু জাহিল! মুখ ব্যাদান করে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসছে তার প্রিয়তম রাসূলের (সাঃ) প্রতি। আর জীবনের শেষ শক্তি টুকু দিয়ে তাঁর প্রিয়তম কে হেদায়েত করছেন তিনি। আমি মাওলানা কাসেমীকে এমনটিই দেখেছি। এটা আমার অনুভব। শুনিনি কারো কাছে।

তখন আমরা ভারতে। দেওবন্দে পড়ি। মাওলানা কাসেমী গেলেন ভারত সফরে। মাদানী মনযিলে মেহমান হলেন। সাক্ষাৎ করলাম সেখানে গিয়ে। সাথে শায়খে কৌড়িয়া । এবং মুফতী আবদুর রহমান সাহেব ও তাশরীফ এনেছেন ফেকহী সেমীনারে। তাঁরা আমার আত্মীয় নন-শরীরের । কিন্তু প্রবাসী মন-স্বদেশী যে কাউকে আত্মীয় ভাবে। আমিও এমনটি ভেবেছিলাম সে দিনে-হৃদয়ের টানেই। ছাত্রদের অনুরোধে শায়েখে কৌড়িয়ার সদয় অনুমতি ক্রমে একটি সম্বর্ধনা সভা হলো। দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস, আমাদের শায়খ মাওলানা আবদুল হক সাহেবের সভাপতিত্বে ।

আবেগাপ্লুত কণ্ঠে আলোচনা করলেন মাওলানা কাসেমী। স্বদেশী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক রুহানী মুরুব্বীর আলোচনা। প্রবাসী সন্তানদের জন্য প্রাণ নিংড়ানো নসীহত বলা চলে। দীর্ঘ দিনের সাধনা, অবিরাম রাজপথের অভিজ্ঞতা আর এ পথে প্রাপ্ত শত ঘাত-প্রতিঘাত যেন উদ্বেলিত করে তুলছিল তাঁকে। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত এক বৃদ্ধজনক যেন পরম আদরের আত্মজকে বুঝাচ্ছেন-ঠিক সেই শিল্পেই ? তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। তিনি বার বার বলে যাচ্ছেন তোমরা এখান থেকে কিছু শব্দজ্ঞান নয়-একটি চেতনা নিয়ে দেশে ফিরবে । নানুতবীর চেতনা, শায়খুল হিন্দের চেতনা, শায়খুল ইসলামের চেতনা।

তোমরা কথিত আলেমের বহর লম্বা করবেনা আশা করি, আশা করি দেওবন্দী চেতনার সদা-সচেতন মুজাহিদ – হয়ে দেশে ফিরবে। তোমরা দ্বীনের জন্যে, দেশের জন্যে, জ্বাতির জন্যে এক নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে দেশে যাবে এই আশায় আমরা পথ চেয়ে থাকবো। আর আমরা সনির্বন্ধ অনুরোধ করবো, আল্লাহর ওয়াস্তে তোমরা তোমাদের চেতনাকে, সাধনাকে তোমাদের বিপ্লব কে বিক্রি করে । দিবেনা-অন্যকোন চেতনার কাছে, টেলিফোনের কাছে, কথিত ইসলামী দেশের কাছে কিংবা কোন ভারী চেকের কাছে।

তোমরা যখন বড় হবে তখন বুঝবে- কিভাবে আমাদের আন্দোলন অন্যদের হয়ে যায়। সে পথ গুলো আমি চিনি। বাস্তবতার ক্ষীপ্রঝড় তোমাদেরকেও একদিন নিয়ে যাবে সেই সত্যের কাছে। সে দিন তোমরা সাবধান থেকো।

আমার কাছে বেশ কিছু ফোন নাম্বার আছে, কিছু জাতীয় ব্যাংকের একাউন্ট নাম্বার আছে, যে সব পথে আমাদের দেশে। ইসলামী বিপ্লব আসে আর যায়। তোমরা ইচ্ছে করলে যাচাই করে দেখতে পার।

কাসেমীর সে ভাষণ কিছু কিছু দেখতে শুরু করেছি ইদানীং। জানিনা আরো কত তিনি জানতেন-আরোকত আমরা দেখবো। আন্দোলনের এ পথ বড় পিচ্ছিল । এখন মনে পড়ে, কাসেমী সাহেবের প্রতিটি কথাই আমাকে আন্দোলিত করছিল। সেদিন তার প্রতিটি কথা ও আচরণ আমার কাছে একান্ত আপন মনে হচ্ছিল। যেন অনেক দিনের চেনা। তারপর কেটে গেল প্রবাসে-নিবাসে কতদিন!

সে দিন রাত এগারটায় যখন অফিস পিওন খবর দিল মাওলানা কাসেমী আর নেই। শরীরের রুধির ধারায় বরফের হিমেল ¯পর্শ অনুভ‚ত হলো। যেন শক্তি পাচ্ছিলামনা এতটুকু। পরদিন সকালে যখন মাওলানা কাসেমীর (রহঃ) পাশে দাঁড়ালাম তখন মনে হলো, এক একান্ত আপনজনের বিয়োগে ক্লান্ত আমি। মাত্র দিন কয়েক আগে (২৯.১০.৯৬) আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বাজানের বিয়োগে বাধভাঙ্গা কান্নায় যেভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম, হৃদয়ে ঠিক তেমনি একটি কান্না শোনলাম আমি-নীরবে দাঁড়িয়ে। হৃদয়ের কান্না। শোনলাম, হৃদয় তার আপন জনকে হারিয়ে কাঁদছে-নিঃশব্দ কান্না।


সূত্র: পয়গামে হক, ১৯৯৬


১৯৯৬ সালের ১৯ অক্টোবর মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শামছুদ্দীন কাসেমী রহ, ইন্তিকাল করেন। আজ তাঁর ইন্তেকাল বার্ষিকী, রহিমাহুল্লাহ।