আল্লামা ওবায়দুল হক রহ. ‘র ইন্তেকালের ১২ বছর: সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ১৬ ২০২০, ১৫:২০

সালাতুর রহমান মাহবুব: বাংলাদেশের আলেম সমাজের অন্যতম এক রাহবার। জীবনের শেষভাগে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, বেফাকুল মাদারিস’র বাংলাদেশের (কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড) সহসভাপতি ও আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ সভাপতি, প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ, রানাপিং মাদরাসার শাইখুল হাদীস আল্লামা ওবায়দুল হক (রহ.) এদেশের মুসলিম মনিষিদের মধ্যে অতুলনীয় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত শাইখুল হাদীস, ফকীহ, মুফাসসির, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্টারিয়ান, সামাজিক ব্যক্তিত্ব, গণমানুষের প্রতিনিধিত্বশীল — সবগুলো গুণেই হযরত ছিলেন যথাযথ গুণান্বিত।

হযরত রহ. ছিলেন উদার-পরিচ্ছন্ন মননের এক অকৃত্রিম বড় মানুষ। উন্নত বেশভূষামুক্ত, আলখাল্লাবিহীন, নিরহংকারী বড় মানুষ। যার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো দ্বীন ও মানবতার কল্যাণে। প্রতিটি কথা ও কাজ ছিলো উদারতা, মমতা ও বিচক্ষণতায় ঘেরা। উস্তায, শাগরিদ, সহকর্মী, জনসাধারণ সবার প্রতি ছিলো উদারতাপূর্ণ আত্নিক মহব্বত। যে কেউ তাঁর কাছে সহজে যেত পারত। যে কোন ব্যক্তি তার যথাযোগ্য মর্যাদা দিতেন, কাছে টানতেন। অনুজদেরকে সম্মুখপানে এগিয়ে দিতেন। এমন এক বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানব তিনি, যার কাছ ভিড়তে পারতেন সবাই। হযরতের সাথে বসা মানে বুদ্ধিদীপ্ত খোশগল্পে মেতে ওঠা। অতি সহজেই যে কাউকেই আপন করে নিতে পারতেন তিনি।

আমাদের জাতীয় ও সমাজ জীবনে তাঁর রয়েছে বহুমুখী ও বিশাল অবদান। কুরআন, হাদিস, ফেক্বাহ, আরবী ও উর্দু সাহিত্য, ইসলামি শিক্ষা বিস্তার ও সাধনার প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিলেন অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব । তাঁর জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রীভূত ছিল ইসলামী দর্শন ভিত্তিতে সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, যা সাধারণ মানুষের চিন্তার ও মুক্তির বার্তারূপে গৃহীত হয়েছে।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে এদেশে বিশুদ্ধ ইসলামি জ্ঞান চর্চার পথ সুগম ছিল না। পরাধীনতার সেই সময়ে নানাভাবে মুসলমানদের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা ছিল। ব্রিটিশের আগ্রাসী তৎপরতায় উপমহাদেশের মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতি, রাজনীতি তখন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত ছিলো । মূলত ঐ সময়টা ছিল এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় , রাজনৈতিক, সামাজিক, অথনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই অধঃপতনের । এমনি যুগ সন্ধিক্ষণে শাইখুল হাদিস আল্লামা ওবায়দুল হক (রহ.) জন্মগ্রহজ করেন।

আল্লামা ওবায়দুল হক (রহ.) বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানি খ্যাত সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর গ্রামে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকাল থেকেই তাঁর শিক্ষা–দীক্ষার সূচনা হয়েছিল পরিপূর্ণ ইসলামী আবহে । কৈশোরের সীমা অতিক্রম করা পর্যন্ত সুযোগ্য পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।তখন তার গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কোনো মাদরাসা ছিল না। এই অবস্থায়ই তিনি নিজ গ্রামের পাশেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর দুবাগ জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেন। প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী এ বালকের প্রতি স্কুলের শিক্ষকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষিত হলো । ইতোপূর্বে তার উপর দৃষ্টি পড়ে আরেক রত্নের, তিনি হলেন সমাজে ইসলামি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের নিবেদিত প্রাণব্যক্তিত্ব মাওলানা আমানুদ্দীন উজিরপুরী।

আল্লামা ওবায়দুল হক’র মেধা ও জ্ঞান পিপাসা দেখে তিনি তার পিতা-মাতার পরামর্শে তার তত্ত্বাবধানেই তিনি রানাপিং মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই চতুর্দিকে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া সম্পাদন করে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ঢাকার বড়কাটারা আশরাফুল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন। তথায় আল্লামা যাকারিয়া (রহ.) এর শাগরিদ আল্লামা মুহিবুর রহমান সারেপারী, মুফতী রহমতুল্লাহ ও পীরজী হুজুর প্রমুখ এর তত্বাবধানে হাদীস তাফসীর ফিকহ্ তথা ইসলাম বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। পরে সেখান থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে তার আপন উস্তাদ আল্লামা রিয়াছত আলী (রহ.) এর নির্দেশে কানাইঘাট উপজেলা লালার চকস্থ একটি মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। মাত্র ৩/৪ মাস শিক্ষকতার পরেই আল্লামা রিয়াছত আলী (রহ.) ‘র অভিপ্রায়ে তার কাছে পৌছার পর ১৯৬০ সালে রানাপিং মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন।

শিক্ষকতার দীর্ঘ জীবনে আল্লামা ওবায়দুল হক (রহ.) ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষাঙ্গনে তার বিরামহীন গতি অন্যদের থেকে তাঁকে আলাদা অবস্থানে নিয়ে আসে। তিনি হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রোজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে ওঠেন তিনি। দীর্ঘকাল যাবত শাইখুল হাদিসের পদে অধিষ্ঠিত থেকে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জনে সক্ষম হন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের অম্লান স্মৃতি বহুকাল পর্যন্ত ধরে রাখবে ঐতিহ্যবাহী রানাপিং মাদরাসা। রানাপিং এর মাটি ও মানুষ তাদের প্রিয় উজিরপুরী (ওবায়দুল হক) হুজুরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে কালের পর কাল।

ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম, সেহেতু মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ.) শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হন। তিনি ছাত্রজীবনে জমিয়াতুুত্তলাবা গঠনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে সম্পৃক্ত হন।

উল্লেখ্য, জমিয়াতুুত্তলাবা ছিল ক্বওমি মাদ্রাসার ইতিহাসে গঠিত প্রথম ছাত্র সংগঠন । এটা ১৯৫৪ সালে ঢাকা উত্তর রানাপিং মাদরাসা থেকে যাত্রা শুরু করেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর হাতেখড়ি হয় শাইখুল হাদীস আল্লামা মুশাহিদ বায়ুমপুরী ও আল্লামা রিয়াছত আলী (রহ.) ’র হাতে। ১৯৮১ সালে হযরত মুহাম্মদউল্লাহ হাফিজ্জী হুজুরের প্রসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আলেম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে একীভূত করেন। তিনি হাফেজ্জী হুজূরের প্রতিষ্ঠিত খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন । কিছুদিন পর খেলাফত আন্দোলনে বিভক্তির সৃষ্টি হলে দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবির সমন্বয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ নামে নতুন রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্নাপ্রকাশ করে। তখন তিনি শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর হাত ধরে সেই থেকেই তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সক্রিয় কর্মী হিসাবে রাজনীতির ময়দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির, ভারপ্রাপ্ত আমির, আমৃত্যু দলের অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেন। স্বীয় মেধা ও যোগ্যতায় তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যথারীতি চালিয়ে যান। খেলাফত মজলিসের কেন্দ্র ঘোষিত সব ক’টি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংগ্রামে আল্লামা ওবায়দুল হক রহ. প্রথম সারিতে থেকে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর সাথে নেতৃত্ব দিয়ে দেশ-জাতি ও ইসলামের সিপাহসালারের ভূমিকা পালন করেন। নাস্তিক মুরতাদ ও তসলিমা বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ধর্মদ্রোহীদের বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিধান সম্বলিত ব্লাস্ফেমী আইন পাসের দাবী সংসদে উত্থাপন করেন। বাবরি মসজিদ ভাঙায় সংসদে তীব্র নিন্দা করে অবিলম্বে বাবরি মসজিদ পুনঃনির্মাণের দাবী জানান এবং শাইখুল হাদীসের ডাকে শান্তিপূর্ণ লংমার্চে গুলি করে ৫ জনকে শহীদ করা হয়। এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন ও তদন্ত কমিটি গঠনের দাবী করেন এবং কওমী সনদের স্বীকৃতির জন্য মুক্তাঙ্গনে শাইখুল হাদিস আজিজুল হক রহ. ‘র সাথে অবস্থান করেন।

শাইখুল হাদীসকে সামনে রেখে স্বীকৃতি আদায়ের উদ্দেশ্যে তাওহীদি জনতা দীর্ঘ ৫ দিন রাজপথে অবস্থান করে ত্যাগের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছিল তা সত্যিই অতুলনীয়। স্বীকৃতির আন্দোলনকে নতুনভাবে আন্দোলিত করেছিল এই অবস্থান কর্মসূচি। এগিয়ে এসেছিল দলে দলে সারা দেশের ছাত্র-শিক্ষক, আলেম-উলামারা। বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল কওমি অঙ্গনের এ দাবির কথা। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. নিজে খোলা আকাশের নিচে যত দিন-রাত অবস্থান করেছেন তাঁর সাথে শাইখুল হাদীস আল্লামা ওবায়দুল হক এম.পি সাহেব রহ.ও ছিলেন। স্বীকৃতির সেই আন্দোলন সংগ্রামের কথা স্মরণ করলে যে নামদ্বয় হৃদয় ক্যানভাসে ভেসে উঠে, তিনি হলেন শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ও শাইখুল হাদীস আল্লামা ওবায়দুল হক এম.পি সাহেব রহ.। স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামে অনেকেই উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুললেও সবচেয়ে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন শাইখুল হাদীসদ্বয় রহ.। সাথে ছিলেন প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান রহ.। তাঁরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উলামায়ে কেরামকে আরও যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে বাতিলের মোকাবেলা করতে হবে। আলেমদের কর্মপরিধি আরও বিস্তৃত করতে হবে। নিজেদের স্বকীয়তা বিনষ্ট না করে কর্মক্ষেত্রের বহুমুখী সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বীকৃতির কোনো বিকল্প নেই। এ বিশ্বাস ছিল বলেই সত্তর এবং নব্বই ছোঁয়া জীবনের পড়ন্ত সময়ে তাঁরা কওমি সনদের স্বীকৃতির দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। কওমি স্বীকৃতির আন্দোলনের উত্তাল সে দিনগুলোর কথা এখনো আমাদের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। আজ স্বীকৃতির ঘোষণা দেওয়া হলো বটে, কিন্তু তাঁরা বেঁচে নেই।

১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭ টি ইসলামী দলের সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে সিলেট-৫ আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে নির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি। বাংলাদেশের সরকারি সংসদে সর্বপ্রথম মাথায় পাগড়ী – হাতে লাঠি অর্থাৎ নবীওয়ালা লেবাস পরিধান করে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, ফলে গোটা বাংলাদেশের ঐ সব দলের তথা ইসলামী ঐক্যজোটের একমাত্র জাতীয় সাংসদরূপে তিনি জাতীয় সংসদে আসন গ্রহণ করেন। ঐ সময়ে গোটা বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ আলেম সমাজের তিনিই ছিলেন মূখ্য ভাষ্যকার ও একমাত্র প্রতিনিধি। শাইখুল হাদীস আজিজুল হক রহ. একদিন কোন মজলিসে বলেছিলেন- গোটা বাংলাদেশে অনেক উলামায়ে কেরাম আছেন তবে শাইখুল হাদীস ওবায়দুল হক একজন হাদীস বিশারদ ও এম.পি। তাই উলামা সমাজে এম.পি সাহেব হুজুর বলতে তিনাকেই বুঝায় এবং এক নামেই গোটা দেশ এম.পি সাব হুজুর বলেই চিনত।

শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ঐ বৃদ্ধ বয়সে তাঁর জানাযায় হাজির হলেন, যা কলবী মহব্বতের আলামত। অবশ্য ঐ সংসদে আরও একজন হক্কানী আলেমও সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি হচ্ছেন কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাউর রহমান খাঁন। কিন্তু তিনি আলেম সমাজের প্রতিনিধিরূপে নহে, বরং বিএনপি দলীয় সংসদরূপে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এম.পি সাব হুজুর রহ. প্রথমই ট্রেনে ওযু ও নামাজের ব্যবস্থার জন্য তৎকালীন (১৯৯১-৯৫) যোগাযোগমন্ত্রীকে জাতীয় সংসদে জবাবদিহি করতে এবং ওযু ও নামাজের ব্যবস্থার জন্য ওয়াদা দিতে বাধ্য করেছিলেন। যার ফল আজও আমরা পাচ্ছি।

ইসলামী ঐক্যজোটের একমাত্র এম.পি হিসেবে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদের বিভিন্ন অধিবেশনে আঞ্চলিক ও জাতীয় বিভিন্ন ইসুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম শাহজালালের পুণ্যভূমি সিলেট বিভাগের দাবি ও নোটিশ উপস্থাপন করে পার্লামেন্টে সিলেটি এমপিদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। তাই বলা যায়, সিলেট বিভাগের প্রথম উপস্থাপক তিনি।

আল্লামা ওবায়দুল হক উজিরপুরী এম পি রহ. সংসদে বলেন- এদেশের মানুষ যদি সত্যিকারের উন্নতি, দূর্নীতিকে নির্মূল করতে, ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে, ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার করতে, সমাজ থেকে অন্যায় অত্যাচার প্রতিরোধ করতে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ যদি তাদের অবস্থার পরিবর্তন এবং দ্রুত সরকারি সেবাসমুহ পেতে চায় তাহলে কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। তিনি সংসদে বারবার বলেছিলেন- বারবার সংবিধান সংসংশো করে লাভ হবে না, শান্তি পেতে হলে কোরআনের আলোকে সংবিধান তৈরি করতে হবে।

শায়খুল হাদিস আল্লামা ওবায়দুল হক এম.পি সাহেব হুজুর রহ. নিজে খরচ বহন করে খেদমতে খালক করে গেছেন। আমরা স্বচক্ষে দেখেছি আল্লামা উজিরপুরী হুজুর রহ. সাধারণ মানুষের সেবার জন্য সরকারি সীল ও প্যাড পকেটেই রাখতেন। যখনই কোন মানুষের সরকারী কোন জিনিসের প্রয়োজন হত, সরকারী প্যাডে স্বাক্ষরের জন্য তখনই তিনি তা দিয়ে দিতেন। উনার পকেট যেন মানব সেবার অফিস ছিল।

আমরা শুনেছি, একবার চৈত্র মাসে বাড়ি থেকে বের হয়ে হেঁটে কোন এক ওয়াজের প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য জনমানবহীন ক্ষেতের জমি দিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে বলল, হূজুর আমার একটা কাজ আটকে আছে। আমার মনে হয় আপনি সরকারি প্যাডে একটা স্বাক্ষর দিলে আমার কাজটা হয়ে যাবে। সাথে সাথে হুজুর পকেট থেকে শীল বের করে শীল ও সাক্ষর করে দিলেন এবং আল্লাহর রহমতে তার কাজটাও সমাধান হয়ে গেল।তিনি প্রায় বলতেন আমার অফিস আমার সাথে থাকত।

অথচ আজ একজন ইউনিয়ন প্রতিনিধির সাথে কথা বলা বা স্বাক্ষরের জন্য বাড়ি থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যায়।এমনকি হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথার জন্যে ডাক্তারের সরনাপন্ন‌ও হতে হয়।

১৯৯৩ সালে বন্যার সময় তিনি ঘরে না বসে জনগণের দুঃখ দুর্দশা লাঘব করার জন্য জনমানুষের খোঁজে কোমর পানির মাঝে বের হয়ে পড়েন। প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান দা.বা. সাহেবের জামাতা বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী ছাত্রনেতা আলহাজ্ব আতাউর রহমান সাহেবসহ অন্যান্য সাথীদের নিয়ে এবং আল্লামা এম.পি হুজুর রহ. দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের মাঝে ত্রাণ নিয়ে জনগণের ঘরে ঘরে গিয়েছিলেন।

সাধারণ মানুষের সেবা ও অধিকার আদায়ের জন্য আজ আল্লামা এম.পি সাব হুজুর রহ. মত বুজুর্গ, আল্লাহওয়ালা, ত্যাগী, তাকওয়াওয়ালা, সহজ-সরল, খোদাভীরু ব্যক্তি বর্তমান সময়ের জন্য বড়ই প্রয়োজন।

শাইখুল হাদীস ওবায়দুল হক রহ. একটি মহান জীবনের মহা নিদর্শন। শেওলা-জকিগঞ্জ রাস্তা, যেই রাস্তার পিছনে একটি ইতিহাস রয়েছে এবং যেই রাস্তার জন্য এম.পি হওয়ার পূর্বে অত্র অঞ্চলের সব জায়গায় ঐ রাস্তার কথা তিনি আলোচনা করতেন। চির স্বরণীয় জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের এম.পি থাকাকালীন শেওলা জিরোপয়েন্ট থেকে বিরশ্রী হয়ে জকিগঞ্জ পর্যন্ত একটি রাস্তা করে দিয়ে ঐ এলাকার মানুষের যাতায়াতের সুবিধা করে দিয়ে গেছেন। এভাবে জনগণের সেবামুলক আরও অনেক অনেক কাজ করেছেন।

কুশিয়ারা নদীর ভাঙনের জন্য সংসদে তিনি বলতেন, বাংলাদেশের মানচিত্র পরিবর্তন হচ্ছে। তিনি সেই এম.পি যিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছিলেন যে, “নদীর এপার ভাঙ্গে ওপার গড়ে এইতো নদীর খেলা” এই কথাটি সিলেটের জকিগঞ্জ কানাইঘাটের জন্য একটি অভিশাপ। কারণ এখানে ভাঙছে বাংলা, ভরছে ভারত, বদলে যাচ্ছে দেশের মানচিত্র। সুতরাং সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধ করে বাংলার মানচিত্রকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এরপর থেকে পাথর দিয়ে ভাঙ্গন প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, আল্লামা উজিরপুরি হলেন ক্বওমিপন্থি উলামায়ে কেরামের প্রথম এবং সফল এক সংসদ সদস্য।

প্রতিটি বাজেট বক্তৃতায় অর্থনীতির সার্বিক সফলতার লক্ষ্যে ইসলামী অর্থনীতি অনুসরণ করার জন্য সংসদকে অবহিত করতেন এবং ইসলামী অর্থনীতির সুফল তুলে ধরে তা বাস্তবায়নের দাবী জানাতেন।

আল্লামা ওবায়দুল হক ৫ বছর সংসদে থাকাকালীন সময়ে সংসদ অধিবেশন না থাকলে দরসে হাদিসের টানে মাদ্রাসায় চলে আসতেন । আধ্যাত্মিকতার জগতে মাওলানা হক (রহ.) ছিলেন প্রখ্যাত বুজুর্গ হযরত মাওলানা আব্দুল গফ্ফার শায়খে মামরখানী (রহ.) এর খলীফা দীর্ঘ পরিশ্রম ও সাধনার শেষে ১৯৭৫ সালে তাজকিয়ায়ে ক্বলবের মেহনতের প্রাপ্তি হিসেবে স্বীয় মুর্শিদ হযরত শায়খে মামরখানী (রহ.) ’র কাছ থেকে ইজাজত হাছিলে সক্ষম হন ।

আপাদমস্তক সুন্নতী সাজে তিনি ছিলেন সারাজীবন সজ্জিত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সায়্যিদুল মুরসালীন (স.) এর আর্দশ প্রতিষ্ঠায় ছিলেন তৎপর। তাকে দেখলেই মনে হতো সুন্নতে রাসূলের এক জীবন্ত মূর্তপ্রতীক।

তিনি ১৭ জানুয়ারি ২০০৮ সালে বৃহস্পতিবার রাতে ইন্তেকাল করেন এবং পরদিন ১৮ জানুয়ারি রোজ শুক্রবার আসরের নামাজের পর জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয় এবং লাখো মানুষের ঢল নামে জানাজা মাঠে।

শেওলা টু জকিগঞ্জ রোডের পাশে ও উজিরপুর জামে মসজিদের পশ্চিমে সাবেক এম.পি শাইখুল হাদীস আল্লামা ওবায়দুল হক উজিরপুরী (রহ.) এর দাফন সম্পন্ন করা হয়। তাঁরই পাশে তাঁরই বড় ছেলে আমি অধমের আব্বা বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী ডাক্তার শামছুল হক রহ. কে সমাহিত করা হয়। আল্লাহ তাঁদেরকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমীন, ছুম্মা আমীন।

 

লেখক পরিচিতি: হাফেজ মাওলানা মুফতি সালাতুর রহমান মাহবুব: পৌত্র, আল্লামা ওবায়দুল হক রহ.। পেশ ইমাম, ফোর্ড স্কয়ার মসজিদ, লন্ডন ।